Advertisment

হারাতে বসেছে ৬০০টি ভাষা, বরাক উপত্যকার ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার

হিমালয়সন্নিহিত অঞ্চলে তুষারকে অন্তত ২০০ টি নামে ডাকা হয়ে থাকে, মুম্বইয়ের কাছে এক গ্রামের লোকজন পুরনো ধরনের একটি পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে থাকেন- শিলচরের ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে গণেশ দেবীর বিশেষ সাক্ষাৎকার

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
language-tree_759

ভারতে একজন মানুষ নিজের বাড়িতে এক ভাষায়, কর্মক্ষেত্রে আরেক ভাষায় এবং বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে অন্য আরেকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন।

অদ্রিজা রায়চৌধুরী

Advertisment

(বিশিষ্ট সাহিত্যসমালোচক গণেশ নারায়ণ দেবী যখন ভারতের ভাষা মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে তিনি এমন কিছু ভাষার সম্মুখীন হবেন, যা বিভিন্ন জায়গায় মুখের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত কিন্তু  সেগুলি কোথাকার ভাষা, তা লোকে জানে না। যেমন, হিমালয়সন্নিহিত অঞ্চলে তুষারকে অন্তত ২০০ টি নামে ডাকা হয়ে থাকে, মুম্বইয়ের কাছে এক গ্রামের লোকজন পুরনো ধরনের একটি পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে থাকেন, গুজরাটের একটি অঞ্চলের মানুষ একধরনের জাপানি ভাষা ব্যবহার করেন, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি জায়গার অধিবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় মায়ানমারের ব্যবহৃত ভাষা।)

২০১০ সালে ভারতের ভাষা জরিপ করার সময়ে গণেশ মোট ৭৮০টি ভাষার হদিশ পান, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি আবিষ্কার করেন যে ৬০০ ভাষা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এবং তিনি দেখেছেন, গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভাষা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গণেশ মনে করেন, একটি ভাষার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় একটি বিশ্বদর্শনভঙ্গিমাও। আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ডট কমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মৃত ভাষা, মরণোন্মুখ ভাষা, ভাষার প্রান্তিকীকরণ, এসব নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশঃ

ভারতের মৃত ও মৃতপ্রায় ভাষাগুলি কী কী?

ইউনেস্কোর হিসেব অনুযায়ী, যে ভাষায় ১০ হাজারের কম মানুষ কথা বলেন, সে ভাষা বিপন্ন। ১৯৭১ সালের জনগণনার সময় ভারত সরকার স্থির করেন, ১০ হাজারের কম মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা নথিভুক্ত হবে না। ফলে, ভারতে ১০ হাজারের কম মানুষ কোনও ভাষা ব্যবহার করলে তা নথিভুক্তই হয়না, এবং ইউনেস্কোর কাছে তা বিপন্ন ভাষা। আমার হিসেবে, ভারতে ব্যবহৃত ৭৮০টি ভাষার মধ্যে ৬০০টি ভাষা সম্ভাব্য বিপন্ন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের জনগণনায় দেওয়া হিসেব অনুসারে মোট ভাষার সংখ্যা ১২২। ফলে বাকি সমস্ত ভাষাকেই সম্ভাব্য বিপন্ন বলে ধরে নেওয়া যায়।

ওয়াডারি, কোলহাটি, গোল্লা, গিসারি প্রভৃতি এরকম বিপন্নপ্রায় ভাষার কয়েকটি উদাহরণ। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা অঞ্চলের যাযাবর প্রজাতির মানুষেরা এ ভাষাগুলিতে কথা বলে থাকেন। এছাড়াও রয়েছে পাউরি, কোরকু, হলদি, মারচি ইত্যাদি উপজাতিদের ব্যবহৃত ভাষা। অসমে রয়েছে মোরান, তাংসা, আইটন। গত ৬০ বছরে ২৫০টির বেশি ভাষা হারিয়ে গেছে। আধুনি, দিচি, গাল্লু হেলগো, কাটাগি - এসব ভাষার চল ছিল এক সময়ে। আন্দামানে ব্যবহৃত বো ভাষা ২০১০ সালে লুপ্ত হয়ে গেছে। সিকিমের মাঝি ভাষা লুপ্ত হয়েছে ২০১৫ সালে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে কোনও একটা ভাষার সঠিক মৃত্যুকাল নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ভাষা কোনও একটা জৈবিক ব্যবস্থার মত নয়। ভাষা একটা বৃহত্তর চিহ্নব্যবস্থা। কোনও একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে চিহ্ন ভেঙে পড়ে না। এ ঘটনা ঘটতে থাকে দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে।

একটা ভাষার মৃত্যু হলে ঠিক কী ঘটে?

একটা ভাষা মরে গেলে সে ভাষার কথকরা অভিচারী হয়ে যান। শুরুতে তাঁরা ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেন, তারপর তাঁরা বাস্তবিকই ভিন জায়গায় চলে যান। দ্বিতীয়ত যেটা ঘটে, তা হল, এই মানুষদের সাবেকি জীবনযাত্রা অনেকটা নিম্নগামী হয়ে পড়ে। এঁদের যদি কোনও বিশেষ নিজস্ব দক্ষতা থেকে থাকে তা-ও লুপ্ত হয়ে যায়। তৃতীয়ত, একটি ভাষার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিরও পরিসমাপ্তি ঘটে। কারণ সমস্ত ভাষারই একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

একটি মৃতপ্রায় ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কী পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে?

খুব সহজ উপায়ে। ওই ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের জীবিকা টিকিয়ে রাখার জন্য সহায়তা করা। নিজেদের ভাষার মধ্যেই যদি কেউ জীবিকানির্বাহের উপায় খুঁজে পান, তাহলে কেউই ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করবেন না।

কিছু ভাষা যখন জনপ্রিয়তা অর্জন করে, সে সময়েই অন্য কিছু ভাষার প্রান্তিকীকরণ ঘটে কেন?

এর কয়েকটা বড়সড় কারণ আছে। একটা কারণ হল বাক্যবিন্যাস। যে ভাষার বাক্যবিন্যাস সহজতর, সে ভাষা জনপ্রিয়। হিন্দি ভাষার বাক্যবিন্যাস ইংরেজি ভাষার বাক্যবিন্যাসের তুলনায় সহজতর। এটা একটা বড় কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। সমাজে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রাচীনকালে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহারকারীরা সমাজে ক্ষমতাশালী হওয়ার কারণে সে সময়ে সংস্কৃত ভাষা জনপ্রিয় হয়েছে। আবার, ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে জনপ্রিয় হয়েছে ইংরেজি ভাষা। তৃতীয়ত, কোনও ভাষা যদি বাজারে চালু হয়, সে ভাষা বেশি দামি হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতে একজন মানুষ নিজের বাড়িতে এক ভাষায়, কর্মক্ষেত্রে আরেক ভাষায় এবং বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে অন্য আরেকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। দিল্লির কোনও এক বাসিন্দা নিজের পরিবারে পাঞ্জাবি বা বাংলায় কথা বলতে পারেন, অফিসে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, সেই তিনিই যখন বাজারে যান, সেখানে তিনি হিন্দি ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা, বাজারের ব্যবহার এবং বাক্যবিন্যাস, এই তিন কারণে কোনও একটি ভাষা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

ভারতীয় ভাষার উপর উপনিবেশিকরণের কী প্রভাব পড়েছে?

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ভাষার উপনিবেশিকরণের ফলে অন্য ভাষা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে, কিন্তু ভারতে তেমনটা ঘটেনি। আমাদের ভাষারা বেঁচে থেকেছে। ঔপনিবেশিক সময়ে ছাপার প্রযুক্তি এসেছে, তবে খুব কম ভারতীয় ভাষাই ছাপার মুখ দেখেছে। যেহেতু আমাদের দেশে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সেজন্য যেসব ভাষায় ছাপার কাজ হয়েছে, সেসব ভাষাগুলি নিজস্ব রাজ্য পেয়েছে। যেসব ভাষা রাজ্য পায়নি, সেসব ভাষাগুলি সরকারি ভাষার স্বীকৃতিও পায়নি, এবং তার ফলে সেসব ভাষাগুলি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থেকে গেছে।

আমরা যে ভাষায় কথা বলি তার সঙ্গে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির যোগাযোগ কী?

আমরা যে ভাষা শিখি বা ব্যবহার করি, তা পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের পরম নিশ্চিত এক আখ্যান শেখায়, ব্যতিক্রমহীনভাবে, সর্বক্ষেত্রে। এর কোন ব্যত্যয় নেই। একটি ভাষার বিশ্ববর্ণনার একটি নিশ্চিত ক্ষমতা রয়েছে এবং চেতনা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ততটুকুই প্রবেশ করতে পারে, বাস্তবতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার যতটুকু ক্ষমতা সেই ভাষার রয়েছে। একটি ভাষার যদি রং বর্ণনা করার জন্য শুধু সাতটি নাম থাকে, তাহলে সে ভাষা ব্যবহারকারী পৃথিবীকে শুধু সাতটি রঙেই দেখতে পারবেন। অন্যদিকে যদি কোনও ভাষার আরও বেশি রং বর্ণনার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সেই ভাষার ব্যবহারকারী পৃথিবীকে দেখবেন বহুরঙে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মারাঠি ভাষায় ‘কিরমিজি’ নামে একটি রংকে বর্ণনা করা হয়, যার কোনও ইংরাজি প্রতিশব্দ নেই। এটা কিছুটা বাদামি, কিছুটা সবজেটে, কিছুটা নীলচে। এটা অনেকটা যেন জোনাকির মতন। এই উপলব্ধিটার অবিকল প্রতিরূপ ইংরেজি ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আবার ইংরেজি ভাষায় নেভি ব্লু বা স্কাই ব্লু রয়েছে, যার যথার্থ অনুবাদ হয়ত অন্য কোনও ভাষায় সম্ভব নয়। এভাবেই কোনও ভাষা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করতে দেয় অথবা দেয় না।

Language Day
Advertisment