রাজনীতিতে সংগঠন বৃদ্ধিতে অন্যের ঘর ভাঙাই দস্তুর। এই তত্ত্বেই এ রাজ্যে সংগঠন শক্তিশালী করছে রাজ্য বিজেপি। তৃণমূল স্তরে সিপিএমের ঘর ভেঙে খানখান হয়েছে। তার প্রমাণ মিলেছে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে। পাশাপাশি রাজ্য স্তরে তৃণমূলেরও ঘর ভাঙছে বিজেপি। তৃণমূলের এই ঘর ভাঙার খেলায় রাজনীতিতে বাড়ছে নাটকীয়তা। ইতিমধ্যেই সূচনা হয়েছে আদি ও নব্য বিজেপির। কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগদানে দলের কেন্দ্রীয় দফতরে দেবশ্রী রায়ের হাজিরা, নাটকের কি সেদিনই ছিল শেষ পর্যায়? কিছুদিন অপেক্ষা করলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন- মমতাকে তৈরি করতে সব নষ্ট করে জীবন দিয়েছিলাম, আর উনিই রাজনীতি করলেন: শোভন
তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুল ঝরিয়ে বড়সড় ঘর ভাঙার খেলা শুরু করেছিল বিজেপি। রাজনীতির অন্দরে চর্চা রয়েছে, প্রথমে মুকুল রায়কে তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙে পৃথক দল করার কথা বলেছিল বিজেপি। তবে মুকুল জানতেন, পৃথক দল করলে ঝুঁকি একটু বেশি হয়ে যাবে। পাশাপাশি সারদাকাণ্ডে তেমন ব্যবস্থা নিলে ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তেমন কোনও লাভ হবে বলেই ধরে নিয়েছিল পদ্মশিবির। লাভের গুড় খেয়ে নিত কংগ্রেস ও বাম জোট। এই সমীকরণের ভয়ে সেই সময় একটু ধীরে চলো নীতি নিয়েছিল রাজ্য বিজেপি। তখন তাদের সাংগঠনিক অবস্থাও ছিল বেশ করুণ। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে বিজেপি। আসামের মডেল অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। সেখানে প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা সারদাকাণ্ডে অভিযুক্ত হেমন্ত বিশ্ব শর্মার মতো এখানে সেই ভূমিকা নেন মুকুল রায়।
লোকসভায় ১৮টি আসন পাওয়ার পর বাড়তি উদ্যমে পদ্মবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ২০২১-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে। কিন্তু যেভাবে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের আগেই দলে আদি ও নব্য বিজেপির দ্বন্দ্ব বাড়ছে, তাতে উদ্বিগ্ন হতে বাধ্য দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর অন্য দলের নেতা-কর্মীরা ঝাঁকে ঝাঁকে যোগ দিতে থাকেন ঘাসফুল শিবিরে। এখন এমনই অবস্থা, দলের তৃণমূল স্তরে আদির থেকে নব্যরা পাল্লায় ভারি। এদিকে লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয় পাওয়ার পার রাজ্য বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়। নীচু স্তরে তৃণমূল ও সিপিএম, দুই দল থেকেই কর্মী-সমর্থকরা দফায় দফায় যোগ দিতে থাকেন পদ্মশিবিরে। ক্ষোভ বাড়তে থাকে পুরনো কর্মীদের মধ্যে।
আরও পড়ুন- ফের পুরসভা ‘ওয়াপসি’, নৈহাটিতে দাপট কায়েম মমতা বাহিনীর
ক্ষমতায় আসার আগেই দলের নব্য ও আদি শিবিরের দ্বন্দ্ব থামাতে না পারলে তার ফলও ভোগ করতে হবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। রাজ্য স্তরে তৃণমূলের একটা বড় অংশ যোগাযোগ করছে বলে দাবি করতে থাকে রাজ্য বিজেপি। যদিও এখনও পর্যন্ত গুটিকয়েক নেতা ছাড়া তেমন কেউ বিজেপিতে যোগ দেন নি। যাঁদের সারদা-নারদা যোগ রয়েছে, তাঁরাই বেশি যোগাযোগ রাখছেন বলে রাজনৈতিক মহলের খবর।
প্রাক্তন মেয়র ও তৃণমূল বিধায়ক শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। নারদাকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্তদের একজন শোভন। দিল্লিতে তাঁদের যোগদানের সময় হাজির ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। তিনিও একসময় শোভনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপির কেন্দ্রীয় দফতরে কে নিয়ে গেলেন দেবশ্রী রায়কে? এখনও কেউ এই ঘটনার দায় নেন নি। প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, শোভনই নিয়ে গিয়েছেন দেবশ্রীকে। পরে ভুল ভাঙে। শোভন জেদ ধরেন, দেবশ্রী বিজেপিতে যোগ দিলে তিনি যোগ দেবেন না। আরও এক পা এগিয়ে বৈশাখী জানিয়ে দেন, ভবিষ্যতে যেদিন দেবশ্রী বিজেপিতে যোগ দেবেন, সেদিন শোভন দল ছেড়ে দেবেন।
আরও পড়ুন- মোদীর ভুটান সফরের আগে বাংলার সঙ্গে আলোচনা হলো না কেন, প্রশ্ন মমতার
সব থেকে বড় বিষয়, শোভনের হুমকির কাছে সেদিন আপাতদৃষ্টিতে নতিস্বীকার করেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। শুধু তাই নয়, দেবশ্রী কার সঙ্গে কথা বলে সেখানে হাজির হয়েছিলেন, তা বলার সৎসাহসও কারো হচ্ছে না। তারপর তিনি কোথায় গিয়েছেন, তাও কেউ বলতে পারছেন না। তৃণমূল কংগ্রেসের এক বিধায়ক বিজেপির সদর দফতরে হাজির হয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমতি ছাড়া, তা যে কিছুতেই হতে পারে না, এটা বুঝতে বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে খুব শীঘ্রই টলিউডের এই অভিনেত্রীর হাতে পদ্মপতাকা দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বৈশাখী যেভাবে আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা বিজেপির মত দলে কতটা গ্রহণীয়, সেটাও বড় বিষয়। কে দলে আসবেন, কে আসবেন না, তা কে ঠিক করবে? বিজেপির কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতৃত্ব এ বিষয়ে একেবারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে রাজনীতির কারবারিদের মতে, এখন থেকেই বিজেপি নেতৃত্ব এবিষয়ে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তেই হবে।