যাকে বলে ম্যারাথন ভোটযুদ্ধ। বঙ্গ ভোটে সেই যুদ্ধই দেখছে আসমুদ্র হিমাচল। ২৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে বাংলার ভোটগ্রহণ। আর ২৯ এপ্রিল অষ্টম তথা শেষ দফার ভোটগ্রহণ। ভোট নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগে থেকেই প্রচারে ঝড় তুলেছে শাসক-বিরোধী সবপক্ষ। দীর্ঘ সেই ভোটপ্রচারে ইতি হল সোমবার। কারণ কমিশনের সংশোধিত সূচি মেনে ভোটের ৭২ ঘণ্টা আগে শেষ করতে হবে নির্বাচনী প্রচার। আর বৃহস্পতিবার রাজ্যের শেষ দফার ভোট।
২০০-র বেশি আসন নিয়ে বিজেপি ‘সোনার বাংলা’ গড়তে সমর্থ হবে? না হ্যাটট্রিক করেই নবান্নে ফিরবেন তৃণমূল নেত্রী? কিংবা ধারে-ভারে বাড়বে সংযুক্ত মোর্চা? তার জন্য আগামি রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে হেভিওয়েট নেতানেত্রীদের নিয়ে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত উড়ে গিয়েছে হেলিকপ্টার৷ ভিভিআইপি নেতানেত্রী থেকে শুরু করে তারকা মুখ, কে ছিলেন না সেই তালিকায়৷
তৃণমূলের তরফে প্রধান দুই মুখ ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই জনে মিলে গোটা রাজ্যে প্রায় ছাড় শতাধিক সভা-জমায়েত করেছেন। এমনটাই ঘাসফুল সূত্রে খবর। অপরদিকে, গেরুয়া শিবিরের প্রধান দুই কান্ডারি নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ, যৌথ ভাবে ৫০টির বেশি সভা-রোড শো করেছে বাংলায়। পিছিয়ে ছিলেন না বিজেপির তারকা প্রচারক মিঠুন চক্রবর্তীও। যদিও বাঙালি বাবুর সঙ্গে পাল্লা দিতে তৃণমূলের হয়ে ভোট প্রচার করে গিয়েছেন ধন্যি মেয়ে জয়া বচ্চন।
তবে, যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন ছিল, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়েই সবথেকে বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল গোটা দেশে৷ প্রচারপর্বে সেই আগ্রহই কয়েকগুন বেড়ে যায়৷ কারণ এই প্রথম প্রায় ৪৪ দিন ধরে হুইলচেয়ারে বসেই বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে প্রচারে ঝড় তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
নন্দীগ্রামে তিনি প্রার্থী হওয়ায় তাঁর সঙ্গে একদা তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য শুভেন্দু অধিকারীর লড়াই গোটা দেশের নজর কেড়ে নিয়েছিল৷ আবার নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে বিজেপি-র হয়ে অন্তত ২০টি জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ প্রথম পাঁচ দফায় নিয়ম করে প্রত্য়েকটি ভোটের দিন রাজ্য়ে একাধিক জনসভা করেছেন তিনি৷ কম যাননি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ৷
নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা, যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়- শাসক দলকে প্যাঁচে ফেলতে কেন্দ্র এবং রাজ্যের তাবড় নেতাদের মাঠে নামিয়েছে বিজেপি, তালিকাটা যথেষ্ট দীর্ঘই৷ ভোট উৎসবের শেষ ভাগে অবশ্য দলের হয়ে নীরবে প্রচার সেরেছেন তৃণমূল সাংসদ দেবও।
তবে তৃণমূল বিজেপি-র প্রথম সারির নেতারা প্রচারে ঝড় তুললেও যথারীতি রহস্যই থেকে গিয়েছে কংগ্রেসকে নিয়ে৷ গোটা নির্বাচন পর্বে রাজ্যে মাত্র একটি জনসভা করতে এসেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি৷ আশা থাকলেও রাজ্যে আসেননি প্রিয়ঙ্কা গান্ধি৷ আর রাহুল গান্ধি যখন এ রাজ্যের জন্য সময় দিলেন, তার কয়েক দিনের মধ্যেই করোনা অতিমারির ধাক্কায় বন্ধই করে দিতে হল প্রচার৷
আবার তারকা মুখ না হয়েও সুবক্তা হিসেবে এবারের নির্বাচনে প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছেন নন্দীগ্রামের সিপিএম প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়৷ এবার ভোটে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন বামেদের তরুণ তুর্কিরা।
এদিকে, ৯ মার্চের দুর্ঘটনার পর থেকে হুইলচেয়ারে চড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একের পর এক জনসভা, রোড শো এবারের নির্বাচনে এ রাজ্যের অন্যতম আলোচিত বিষয়৷ আবার এ বারই বেনজির ভাবে নির্বাচন কমিশনের শাস্তির কোপে পড়ে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে তৃণমূলনেত্রীর উপর৷ পাল্টা নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের বিরুদ্ধেও একাধিকবার বিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে তৃণমূল৷
প্রধানমন্ত্রীর মুখে 'দিদি ও দিদি' কটাক্ষ, বা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে 'বহিরাগত' আক্রমণ- গত দেড় মাসে বাছাই কিছু উক্তি, শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলা৷ তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে সবকিছুকেই হয়তো ছাপিয়ে গিয়েছে 'খেলা হবে' স্লোগান৷ তৃণমূল, বিজেপি, বাম, কংগ্রেস- পরস্পরকে বিঁধতে খেলা হবে স্লোগানই হয়ে উঠেছিল প্রত্যেকের হাতিয়ার৷
এবার প্যারডিও ভোট প্রচারে বেশ নজর কেড়েছে। তৃণমূলের ‘খেলা হবে’র পাল্টা ছিল বিজেপির ‘বেলা চাও’-এর অনুকরণে তৈরি পিসি যাও গান।
চমক ছিল বামেদের প্রচারেও। বিজেপি, তৃণমূলকে বিঁধে 'টুম্পা', 'লুঙ্গি ডান্স'-এর প্যারোডি গান হোক অথবা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের পাঞ্চ লাইন ব্যবহার- বামেদের তরুণ ব্রিগেড চমকের পর চমক দিয়েছে৷ আবার বিভিন্ন কেন্দ্রে হাজির হয়েছে বামেদের হল্লা গাড়ি৷
কোন পক্ষ প্রচারে মাত করল, সেটার জন্য আর একসপ্তাহ অপেক্ষা। তবে দীর্ঘ ভোটযুদ্ধের শেষে গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হল, সেটা ভোটদানের হার থেকেই স্পষ্ট।