প্রার্থী কি কম পড়িয়াছে? বিজেপির তৃতীয়-চতুর্থ দফার প্রার্থীতালিকা দেখে এমন প্রশ্ন উঠছেই। এদিন তৃতীয় ও চতুর্থ দফা মিলিয়ে মোট ৬৩ জনের নাম ঘোষণা করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এই তালিকায় জায়গা পেয়েছে দলের চার সাংসদ এবং তৃণমূলত্যাগী চার বিধায়ক। এদিন যে ৬৩ জনের তালিকা প্রকাশ হয়েছে, তাতে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি—বাবুল সুপ্রিয়, স্বপন দাশগুপ্ত, নিশীথ অধিকারী আর লকেট চট্টোপাধ্যায়ের। পাশাপাশি নাম রয়েছে রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর ঘোষাল, দীপক হালদার এবং বিশ্বনাথ কারকের।
এখানেই শেষ নয়। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, পরবর্তী তালিকায় আরও কয়েকজন সাংসদের নাম থাকতে পারে। রাজ্যসভা সাংসদ অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের নামও থাকতে পারে সেই তালিকায়। কিন্তু সাংসদ এমনকী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকেও কেন বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে, রাজ্য বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতার দাবি, ‘আমরা ক্ষমতায় আসছিই। মন্ত্রিসভা কেমন হবে তার স্পষ্ট ছবি রয়েছে প্রার্থী তালিকাতেই।’ যদিও পাল্টা আক্রমণ শানাচ্ছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র তথা রাজ্যের মন্ত্রী তাপস রায় বলেন, ‘বিজেপি-তে এখন নব্য ও পুরনো বিজেপির মধ্যে প্রবল লড়াই। সে সব মেটানোর পাশাপাশি প্রার্থী হওয়ার মতো মুখেরও অভাব। সেই দৈন্যই প্রকাশ পেয়েছে তালিকায়।’
রবিবার দু’দিনের রাজ্য সফরে এসেছেন অমিত শাহ। তারই মধ্যে জানা গেল বিজেপি-র আরও দুই দফার প্রার্থীতালিকা। প্রতি সফরেই অমিত বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় আসছে বলে প্রত্যয় দেখিয়েছেন। এদিনও খড়গপুরের রোড শো থেকে সেই হুঙ্কার দিয়েছেন। বিজেপি সত্যিই নীলবাড়ির দখল পেলে কে হবেন মুখ্যমন্ত্রী? এ ব্যাপারে অমিত বরাবর বলে এসেছেন, ‘বাংলার ভূমিপুত্র’। কিন্তু কেমন হবে পদ্মের স্বপ্নের মন্ত্রিসভা? ফেব্রুয়ারির সফরে সংবাদমাধ্যমের এমন প্রশ্নের উত্তরে অমিত বলেছিলেন প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হলেই মন্ত্রিসভা দেখতে পাওয়া যাবে।
সেটাই কি বিজেপি দেখাতে চাইল এই দফার প্রার্থী তালিকার মধ্যে দিয়ে? যে তিন জন লোকসভার সাংসদ প্রার্থী হয়েছেন তার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাবুল। পরপর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে আসানসোল আসন থেকে জিতেছেন বাবুল। দু’বারই জায়গা পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভায়। এ বার নবান্ন দখলের লড়াইয়ে জয়ের সম্ভাবনা দেখা বিজেপি বিধানসভাতেও চাইছে সাংসদ বাবুলকে। বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গায়ক বাবুল প্রার্থী হচ্ছেন টালিগঞ্জ আসন থেকে। প্রসঙ্গত, লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই কেন্দ্র বিজেপি-র কাছে মোটেও ‘সুবিধাজনক’ নয়। ২০১৯ সালে যাদবপুর লোকসভার অন্তর্গত টালিগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের থেকে বিজেপি পিছিয়ে ছিল প্রায় ৩২ হাজার ভোটে। তবে রাজনৈতিক মহলে এমন জল্পনা যে, নন্দীগ্রামের পাশাপাশি টালিগঞ্জ থেকেও ভোট লড়তে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন ইঙ্গিত তিনি নিজেই দিয়ে রেখেছেন। সেটা যদি হয় তবে নন্দীগ্রামের পাশাপাশি টালিগঞ্জও হয়ে উঠবে ‘হেভিওয়েট’ আসন। বিজেপি সূত্রে খবর, তেমনটা আন্দাজ করেই বাবুলে ভরসা রাখছে বিজেপি। তবে আপাতত বাবুলের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। যদিও পর্যবেক্ষকদের একটা অংশ বলছে, দেবদূত ঘোষের প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে বেরিয়ে যেতে পারেন অরূপ বিশ্বাস। ঠিক যেমনটা ২০১৬ সালে হয়েছিল ভবানীপুর কেন্দ্রে। সেই আসনেও ত্রিমুখী লড়াই হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাম-কংগ্রেস মনোনীত দীপা দামুন্সি এবং বিজেপির চন্দ্র বসু। ফল ঘোষণার দিন দেখা গিয়েছে, দীপা দাশমুন্সি ২৫ হাজারের কিছু ভোটে পরাজিত। আর সেই সংখ্যক ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে বিজেপির চন্দ্র বসু।
এবার টালিগঞ্জে সেই সমীকরণের প্রতিফলন দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। অর্থাৎ প্রথম লোকসভা ভোটের নিরিখে তৃণমূলের এগিয়ে থাকা আর দ্বিতীয় দেবদূত ঘোষ ফ্যাক্টর, বিশেষ করে বাম উপস্থিতি। সেক্ষেত্রে টালিগঞ্জে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন মোদী-শাহের নয়নের মণি বাবুল সুপ্রিয়।
অন্য দিকে, কলকাতারই কোনও কেন্দ্র থেকে রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে প্রার্থী করা হবে বলে ভাবা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হুগলির তারকেশ্বর আসন থেকে প্রার্থী করা হয়েছে। বিজেপি-তে তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত স্বপনকে কোনও ‘সুবিধাজনক’ আসনে প্রার্থী করার কথা আগেই ভেবেছিল বিজেপি। সেই হিসেবে তারকেশ্বরকে বিজেপি-র পক্ষে খুব ‘সুবিধাজনক’।এটা বলা যেতেই পারে। বিজেপি-র ওই এলাকায় দলের সাংগঠনিক শক্তি বেড়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে আরামবাগ আসনে মাত্র ১,১৪২ ভোটের ব্যবধানে হেরেছিল বিজেপি। তবে আরামবাগ লোকসভার অন্তর্গত তারকেশ্বরে বিজেপি পিছিয়ে ছিল প্রায় ৫ হাজার ভোটে।
রাজ্য বিজেপি-র সাধরণ সম্পাদক তথা সাংসদ লকেট প্রার্থী হয়েছেন চুঁচুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে। তাঁর হুগলি লোকসভার মধ্যেই এই বিধানসভা এলাকা। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রার্থী হতে বলার পরে লকেট নিজেই এই আসন থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে বিজেপি ওই আসনে ২০ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল।
অন্য দিকে, কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ বিজেপি-তে নতুন হলেও ইতিমধ্যেই দলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি অমিত কোচবিহারে সমাবেশ করার আগে অসমে রাজবংশীদের রাজা হিসেবে পরিচিত অনন্ত রায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাতেও অমিতের সঙ্গী ছিলেন নিশীথ। এ বার তিনি প্রার্থী কোচবিহারের দিনহাটা আসন থেকে। লোকসভা ভোটে এই আসনে ১৫ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন নিশীথ। তবে, বিজেপির সমীকরণ যাই থাকুক, পর্যবেক্ষকদের মতে, খানিকটা প্রার্থী অল্পতায় ভুগছে বিজেপি। তাই এখনও পর্যন্ত তৃণমূল-ধর্মনিরপেক্ষ জোট (বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ) প্রচারে ঝড় তুললেও, এগিয়ে আসতে পারেনি বিজেপি।
ভোটের দিন ঘোষণার আগে ও পরে যে ভাবে বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল, তাতে ভাবা হয়েছিল সব পরিচিত মুখ প্রার্থী। কিন্তু দিন যত এগোচ্ছে, ততই তৃণমূলত্যাগী আর বিজেপি সাংসদদের ভিড় বাড়ছে প্রার্থী তালিকায়। যা দেখে ওয়াকিবহাল মহল প্রশ্ন করছে, প্রার্থী কি কম পড়িয়াছে?