নগদের বিনিময়ে প্রশ্ন তোলায় শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) টিএমসি সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সংসদ পদ বাতিল করা হয়। সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি মৈত্রকে বহিষ্কারের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেব যা লোকসভা ধ্বনিভোটে অনুমোদিত হয়। লোকসভায় এই নিয়ে আলোচনা চলাকালীন সরকারের ওপর বিধি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে সংসদে ও বাইরে জবাব দিয়েছে বিজেপি।
মনীশ তিওয়ারি কী প্রশ্ন তুলেছেন?
কংগ্রেসের তরফে মণীশ তিওয়ারি বলেছিলেন “আমাদের তিন-চার দিন সময় দেওয়া হলে তাতে কোন সমস্যা হত না। আমরা রিপোর্টটি পড়ে হাউসের সামনে আমাদের মতামত পেশ করতে পারতাম”। বিজেপি সাংসদ অপরাজিতা সারঙ্গি দাবি করেছেন যে মহুয়া মৈত্র কমিটির বৈঠকে অসাংবিধানিক শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তিনি সভা থেকে বেরিয়ে গেছেন। মণীশ তিওয়ারির প্রশ্নে ওম বিড়লা বলেন, এটা সংসদ, আদালত নয়। আমি বিচারক নই, আমি চেয়ারম্যান…এখানে আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না, কিন্তু হাউস সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
মহুয়া মৈত্রকে কেন সুযোগ দেওয়া হল না?
হাউসে এথিক্স কমিটির রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা চলাকালীন, টিএমসি সাংসদ সুদীপ বন্দোপাধ্যায় লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে বলেছিলেন যে মৈত্রকে তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত। সুদীপ বন্দোপাধ্যায় বলেন, 'অভিযুক্ত ব্যক্তির কথা শুনলেই তবেই ন্যায্য বিচার হয়'।
এই যুক্তি দিয়েছেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী
সুদীপ বন্দোপাধ্যায়ের যুক্তির জবাবে সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী বলেছেন, “প্রাক্তন লোকসভা স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জির সময় ১০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সে সময় চ্যাটার্জি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে অভিযুক্ত সাংসদরা কমিটির সামনে হাজির হয়েছেন, তাই তাদের সংসদে কথা বলার অধিকার নেই।
কোন প্রমাণ নেই- মহুয়া মৈত্র
হাউসের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার বিষয়ে, মহুয়া বলেন "তিনি এমন আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন যার কোনও প্রমাণ নেই।" তিনি যোগ করেছেন আদানি গ্রুপের কারণেই তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদ।
এই উত্তর দিয়েছেন প্রহ্লাদ জোশী
সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর সঙ্গে কথা বলার সময়, বিরোধী এবং মহুয়া মৈত্রের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রহ্লাদ যোশি বলেন তিনি (মহুয়া মৈত্র) নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানির কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন।
মহুয়া মৈত্র কি সাংসদ পদ ফিরে পেতে পারেন? জেনে নিন আইনি বিকল্প কি
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে সদস্যপদ প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। মহুয়ার আবেদনে হস্তক্ষেপ করবে কি না তা আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ বিষয়টি সংসদের এখতিয়ারের অধীনে, হাউসের স্পিকারের সিদ্ধান্ত এই ক্ষেত্রে চূড়ান্ত।
তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র, যিনি নগদ এবং উপহারের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন তোলায় লোকসভার সদস্যপদ হারিয়েছেন, তিনি দেশের যে কোনও হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন। লোকসভা থেকে তার সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। আইনজ্ঞদের মতে, ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘনের ভিত্তিতে যে কোনো ব্যক্তি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। এমতাবস্থায়, তাকে তার যুক্তি ও নথির মাধ্যমে আদালতের সামনে স্পষ্ট করতে হবে যে তাকে সংসদের বিশেষ কার্যধারায় তার পক্ষ উপস্থাপনের উপযুক্ত সুযোগ দেওয়া হয়নি। তদন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তদন্ত প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে। যদি মহুয়ার কাছে এমন সকল নথি থাকে তবে তার ভিত্তিতে মহুয়ার এখনও হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন মহুয়া।
সংবিধানবিদ জ্ঞানন্ত সিং এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনুপম মিশ্রের মতে, সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্তকে একটি রিট পিটিশনে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। তবে মহুয়ার পিটিশনে হস্তক্ষেপ করবে কি না করবে তা আদালতের বিবেচনার ভিত্তিতে, কারণ হাউসের স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। গত সেপ্টেম্বরে, সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির একটি বেঞ্চ সংসদ ও রাজ্য বিধানসভায় ভোটের জন্য ঘুষ নেওয়ার জন্য সাংসদ ও বিধায়কদের দায়ের করা মামলার বিষয়ে শুনানি করতে সম্মত হয়েছিল।
চাইলে এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার জন্য লোকসভার স্পিকারের কাছে অনুরোধ জানাতে পারেন মহুয়া মৈত্র। তবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে স্পিকারের বিবেকের উপর। তিনি চাইলে দ্বিতীয়বার এই নিয়ে পর্যালোচনা নাও করতে পারেন।পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন মহুয়া। এ ছাড়া মহুয়া বলতে পারেন, এথিক্স কমিটি নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। কমিটির কার্যকলাপ অনৈতিক ছিল বলে দাবি করতে পারেন। বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে এথিক্স কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দিল্লি হাইকোর্টে মহুয়া যে মানহানির মামলা করেছেন, তার মাধ্যমে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত থেকে রেহাই চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ নিন্দনীয়, মনগড়া। এতে তাঁর সম্মানহানি হয়েছে। অথবা, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ফের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন তৃণমূলের এই নেত্রী।
লোকসভার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন মহুয়া
মহুয়া মৈত্র লোকসভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংবিধানের ২২৬ অনুচ্ছেদের অধীনে হাইকোর্টে এবং আর্টিকেল ৩২-এর অধীনে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে পারেন। যাইহোক, এই জাতীয় বিষয়গুলি সংসদ এবং স্পিকারের ক্ষমতার আওতার মধ্যে পড়ে, যা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে। কিন্তু সংসদে পাস হওয়া আইন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যায়। মহুয়া নির্দোষ প্রমাণিত হলে তার সাংসদ পদ ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে । দোষী সাব্যস্ত হলে সব পথ বন্ধ হবে মহুয়ার।
মহুয়া মৈত্রের জেল হতে পারে?
এথিক্স কমিটি মহুয়া মৈত্রের সাংসদ বাতিলের সুপারিশ করেছে পাশাপশি এই পুরো বিষয়টির আইনি তদন্তের সুপারিশ করেছে। মহুয়া মৈত্রের আর্থিক লেনদেনের অপরাধমূলক দিকগুলি কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির মাধ্যমে তদন্ত করা হবে। এরপর সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশিট দাখিলের পর আদালতে মামলা হবে। ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে জেলে যেতে পারেন তৃণমূল সাংসদের।
তিনি কি আবার নির্বাচনে লড়তে পারবেন? ফৌজদারি মামলার তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত মহুয়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। কিন্তু মহুয়া মৈত্রের যদি ফৌজদারি মামলায় ২ বা তার বেশি বেশি সাজা হয়, তাহলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে মহুয়ার। তবে ফৌজদারি মামলার বিচার ও শাস্তি হতে সময় লাগে। ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য ৬ মাসেরও কম বাকি। এমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণের মধ্যে যাওয়ার আগে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মহুয়ার হাতে সময় কম।
দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি কতদিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না?
১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে সাংসদ ও বিধায়কদের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের 8 ধারায় লেখা আছে যে কোনো সাংসদ বা বিধায়ক যদি ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তিনি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে পরবর্তী ৬ বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
রাহুল গান্ধীর থেকে মহুয়া মৈত্রের মামলা কতটা আলাদা?
উভয় ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোদী উপাধি জড়িত মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেয় সরাতের একটি আদালত। এর পর জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে রাহুল গান্ধী তার সাংসদ পদ হারান। তবে সুপ্রিম কোর্ট রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ পুনর্বহাল করেছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, 'রাহুল গান্ধীর আবেদনের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ থাকবে।' শুনানির নতুন তারিখ এখনও ঘোষণা করা হয়নি।
এর আগেও কি কোনো সাংসদ ক্যাশ ফর কোয়েরি মামলায় জড়িত ছিলেন?
মহুয়া মৈত্রের মতো একটি মামলা সামনে আসে ২০০৫ সালে। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৫-এ, ১০ জন লোকসভা সাংসদ এবং একজন রাজ্যসভা সাংসদ (ছত্রপাল সিং লোধা) ঘুষ নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। বরখাস্ত হওয়া সাংসদের মধ্যে ৬ জন বিজেপির, ৩ জন বিএসপির। যেখানে কংগ্রেস ও আরজেডির একজন করে সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল।