সাহিত্যিক শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ছিলেন বীরভূমের প্রান্তিক এলাকা খয়রাশোলের মানুষ, তিনি লিখছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস কয়লাকুঠির দেশে। সেই কয়লাকুঠির দেশে ২০১২ সাল থেকে আগুন জ্বলছেই। একটু এগিয়ে গেলে ঝাড়খণ্ড, অন্যদিকে অজয় নদী টপকালে বর্ধমান। ২০০৬ সাল থেকে এ অঞ্চলে ছিল মাওবাদীদের ডেরা, ৭ জন সিপিআই( এম)-এর শীর্ষ নেতা কর্মী সেসময়ে এই এলাকায় খুন হন। খুনের দায় স্বীকার করেছিল মাওবাদীরা। পরিবর্তনের পর এখন শাসক দলে তৃণমূল, এবার তারা নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ল বলে অভিযোগ।
২০১২ সালের ২১ শে মে দুবরাজপুরে খুন হন খয়রাশোলের তৃণমূল নেতা বুড়োসেখ, সেই খুনের বদলায় সেদিনই খুন হন বিপক্ষ গোষ্ঠীর খোকন সরকার এবং আনিসুর রহমান। দলের কর্মীরাই আগুন লাগান তাদের দলীয় দফতরে, এ কথা এখনও বলাবলি করেন স্থানীয় মানুষজন। ২০১৩ সালের ১২ ই আগস্ট দিনের বেলায় খুন হন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষ। এবারেও অভিযোগের ধরন একই। আঙুল উঠল দলেরই বিপক্ষ গোষ্ঠির নেতা অশোক মুখার্জির দিকে। প্রাণ বাঁচাতে বোলপুরে দলের জেলা দপ্তরে ঠাঁই নিলেন অশোক মুখার্জি, এক বছর এলাকা ছাড়া থাকলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। এক বছর পর এলাকায় ফিরে নিজের বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি খুন হলেন। এমন ছোট বড় নেতা খুন চলছেই। একমাস আগে সংলগ্ন এলাকায় তৃণমূলের একটি পাকা সিমেন্টের ঢালাই করা বিরাট অফিস বিস্ফোরণে উড়ে গেল ! ফরেনসিক তদন্তে ধরা পড়ল ভেতরে মজুত ছিল বিশাল পরিমাণ বিস্ফোরক। গ্রেফতার হলেন তৃণমূলেরই স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
আরও পড়ুন, মৃত্যু হল খয়রাশোলের জখম তৃণমূল ব্লক সভাপতি দীপক ঘোষের
আপাতত সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে রবিবার, ভোজালির কোপে জখম এবং গুলিবিদ্ধ হন বর্তমান ব্লক সভাপতি দীপক ঘোষ। সোমবার মারা গেলেন তিনি। মনে রাখতে হবে, দীপক ঘোষের দাদা অশোক ঘোষও তৃণমূলের ব্লক সভাপতি থাকাকালীন খুন হয়েছিলেন।
তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন দীপক ঘোষ, কয়েকমাস আগে অনুব্রতর মাথায় রুপোর মুকুট পরিয়ে তাঁকে বরণ করেছিলেন এই সদ্যনিহত ব্য়ক্তি।
যেভাবে একের পর এক তৃণমূল নেতারা খুন হয়ে চলেছেন আর খুনী হিসেবে পুলিস তৃণমূলেরই নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে তাতে বিপাকে অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর দাবি, এসবই করছে বিজেপি, ঝাড়খণ্ড থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে দুষ্কৃতীদের। তবে তিনি এর বদলা নিয়ে ছাড়বেন বলে জানিয়েছেন।
পুলিস গোটা ঘটনায় শাসক দল ও সরকারকে রক্ষায় মুখে কুলুপ এঁটেছে। সাতজন তৃণমূল নেতা কর্মীকে দীপক ঘোষ খুনের ঘটনায় বাবুইজোড়, ইসলামপুর, কদমডাঙা প্রভৃতি এলাকা থেকে পুলিস গ্রেফতার ও করেছে। কিন্তু কেন খুন হলেন দীপক ঘোষ? প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসছে এলাকার কয়লার চোরাচালানের রাশের বিষয়? কার হাতে থাকবে এত টাকার লেনদেন?
খয়রাশোলে তৃণমূল নেতার মৃত্যুর পিছনে বিজেপি-র হাত রয়েছে, দাবি অনুব্রত মণ্ডলের। বদলা নেবে দল, হুমকি তৃণমূল নেতার pic.twitter.com/nW5UA0LWzk
— IE Bangla (@ieBangla) October 22, 2018
এই এলাকা কয়লার স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। লাগোয়া কাকড়তলা এলাকায় ছিল ই সি এলের কোলিয়ারি, ১৯৯৫ সাল থেকে সেই কোলিয়ারিকে অলাভজনক বলে চিহ্নিত করে কয়লা উত্তোলন বন্ধ করে দেয় ই সি এল। এরপর ধীরে ধীরে লাগোয়া সগড়ভাঙা সহ বিরাট সীমান্তবর্তী এলাকায় খোলামুখ খনির বিশাল পরিমাণ কয়লা ট্রাকে করে পাচার হতে থাকে পুলিসের একাংশের মদতে। আর রুক্ষ এই এলাকার অনেক মানুষ রোজগারের অন্য কোন পথ না পেয়ে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়েন এই অপরাধ চক্রে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ভীমগড় থেকে পলাশথলির রেলপথের নিচ থেকে কয়লা তুলে চোরাকারবারিরা রেলপথকে শূন্যে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই কারণে এ পথে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। ই সিএল স্থানীয় প্রশাসনকে কয়লা রক্ষার ব্যাপারে আর্জি জানালেও নিজেরা কোনওরকম উত্তোলন না করায় অপরাধের শিকড় ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়।
পুলিস সূত্রেই খবর, রাজ্য রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় মানুষ থেকে বেঙ্গালুরুর কর্পোরেট পরিবহণ ব্যবসায়ী, দুর্গাপুরের কয়লা মাফিয়া, কয়েকজন পুলিশ কর্তা, এবং রাজনৈতিক নেতা- এসব বড় বড় মাথারা জড়িয়ে রয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকার এই বেআইনি ব্যবসায়। একসময়ে এখান থেকে সরাসরি দিনরাত ট্রাকে করে কয়লা পাচার হলেও কয়েক মাস ধরে সে প্রথা বন্ধ। তবে তৃনমূলেরই স্থানীয় কিছু গ্রাম স্তরের নেতারা বলছিলেন ভীমগড়ের এক কয়লা পাচারকারী শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে ফের বিক্ষিপ্তভাবে কয়লা পাচার শুরু করেছিল, যার মাথায় আবার দুর্গাপুরের এক বড় মাফিয়ার হাত আছে। তাঁরাই জানালেন তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবার পঞ্চায়েত গঠনের পরে, পুজোর আগে আগে খয়রাশোলের কেন্দ্রগড়িয়া গ্রামে এক সভা করে ভীমগড়ের ঐ কয়লামাফিয়ার নাম করে গালিগালাজ করে হুমকি দিয়েছিলেন দীপক ঘোষ। এই খুনের সঙ্গে তার কোনও যোগসূত্র আছে কিনা সে নিয়ে তদন্ত করছে পুলিস। আরও নানা দিক খতিয়ে দেখতে সাতজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছেন পুলিস অফিসাররা!
সোমবার খয়রাশোল এলাকার মানুষরা স্পষ্টভাষায় বলছিলেন কয়লার ব্যবসা চললে বাজার ভালো থাকে, মানুষের আয় বাড়ে, দোকানপাট বাজার রমরম করে, কিন্তু কয়লার চোরাচালান বন্ধ হলে শুকিয়ে যায় গোটা এলাকা ।
কিন্ত একের পর এক মানুষ এই কয়লাচক্রে পড়ে প্রাণ হারাবেন এটাই কি ভবিতব্য খয়রাশোলের?