নেত্রীর ছবি ছাড়া ঘাসফুল প্রতীকে যদি কেউ জিততে পারেন, তাহলে সেই ব্যক্তি তিনিই। তৃণমূলের অন্দরে বা বাইরে কান পাতলে এত বড় শংসাপত্রটি যিনি পেয়ে থাকেন তিনি 'নন্দীগ্রামের নায়ক'। এবার সেই 'নায়ক' শুভেন্দুর সঙ্গেই দলের দূরত্বের জল্পনা ক্রমশ দানা বাঁধছে। সূত্রের খবর, দলনেত্রীকে তিনি সটান জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর আদেশেই চলতে চান, অন্য কারও (পিকে-অভিষেক?) পরামর্শ তিনি মানবেন না। মালদায় দলনেত্রীকে কাছে পেয়ে কথার ইঙ্গিতে এমনটাই জানিয়েছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী।
পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী পরিবারের কেউই ২ মার্চ 'বাংলার গর্ব মমতা' বৈঠকে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোরের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না। এই গড়হাজিরা নিয়েই সোশাল মিডিয়া তোলপাড় চলেছে। কেন তাঁরা সেদিনের সভায় যাননি তা নিয়ে নানা মতামত উঠে এসেছে সোসাল মিডিয়া এবং তৃণমূল জনতার মধ্যে থেকে। এরই মধ্য়ে ৪ মার্চ পুরাতন মালদার ছোটো সূর্যপুরে তৃণমূলের কর্মী সম্মেলনে একই মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ও মালদার তৃণমূল পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী।
এদিন মালদার সভার শুরুতে তৃণমূল সুপ্রিমো ও শিশির-পুত্রের মধ্য়ে একটা 'মানসিক দূরত্ব' লক্ষ্য় করছিলেন অনেকেই। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে খবর, ওই দিন কেন নেতাজি ইন্ডোরে তিনি হাজির হননি, সেকথা নেত্রীকে জানিয়ে দেন শুভেন্দু। ওই সূত্রেরই দাবি, মালদায় দলনেত্রীকে একান্তে তিনি বলেছেন, "আপনি আমার নেত্রী। আপনি যে নির্দেশ দেবেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আপনি যদি দল ছাড়তে বলেন, তাহলে দলও ছেড়ে দেব। আপনার নেতৃত্বে আমি রাজনীতি করছি এবং করব। কিন্তু অন্য় কারও কথায় রাজনীতি করতে পারব না"। জানা গিয়েছে, দলের এই দাপুটে যুবনেতার মুখে এমন কথা শুনে তৎক্ষণাৎ কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি নেত্রী।
আরও জানা যাচ্ছে, আগে থেকেই নাকি দলনেত্রীকে শুভেন্দু বলে দিয়েছিলেন, নেতাজি ইন্ডোরের অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন না। কিন্তু, শুভেন্দু উপস্থিত হতে অপারগ হলেও তাঁর বাবা তথা সাংসদ শিশির অধিকারী এবং ভাই তথা বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারী কেন অনুপস্থিত থাকলেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
একুশের মহারণের আগে তৃণমূল দলকে সুসংহত করতে যৌথভাবে কাজ করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পিকের আইপ্যাক। ভাবমূর্তি গঠনের জন্য দলীয় নেতা-কর্মীরা কেমন আচরণ করবেন সে বিষয়েও রীতিমতো নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন কর্পোরেট ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোর। 'দিদিকে বলো' এবং 'বাংলার গর্ব মমতা'র মতো প্রচার কৌশলও তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এদিকে, যে আবেগের গণআন্দোলনে (সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম) সওয়ার হয়ে ২০১১ সালে ঐতিহাসিক জয় পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস, শুভেন্দু অধিকারী তারই 'পোস্টার বয়'। তাছাড়া এমনতিতেও মেদিনীপুরের অধিকারী পরিবার বরাবরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কারও প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেনি।
যুবনেতা হিসাবে কে এগিয়ে, অভিষেক না শুভেন্দু, এমন প্রশ্নও একসময় বেশ ঘুরপাক খেত তৃণমূলের অন্দরে। এরপর একদিকে যেমন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃণমূল যুবকংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি করা হয় তেমনই লোকসভা থেকে ফিরিয়ে এনে শুভেন্দুকে ২০১৬ সালে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করেন মমতা। এছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দলকে নির্বাচনী বৈতরণী পারের দায়িত্বও দেওয়া হয় শুভেন্দুকে। সে কাজে তিনি একরকম সফলও বটে। এমতাবস্থায় শুভেন্দু মমতাকে 'শুধুমাত্র আপনার আদেশেই চলব, অন্য কারও কথায় নয়' বলার মাধ্যমে পিকে-অভিষেক জুটির প্রতি অনাস্থা দেখালেন বলেই মনে করা হচ্ছে। এছাড়া, নেত্রী বললে দল ছেড়ে দেব, শুভেন্দুর এই কথাও কপালে ভাঁজ ফেলছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। তবে এই দূরত্ব যদি বজায় থাকে বা বাড়ে, তাহলে তা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে যে নয়া মাত্রা যোগ করবে তা সুনিশ্চিত।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন