তৃতীয়বারের জন্য বাংলা দখল সম্পূর্ণ। এবারে প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা অভিযান শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। নিজের রাজনৈতিক হাতেখড়ি কলকাতায়। কলেজে পড়ার সময় দাপিয়ে ছাত্রপরিষদ করতেন মহানগরে। এখন তিনি ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেসের হাল ধরেছেন। আশিসলাল সিং রাঠোর যদিও অধিক পরিচিত আশিসলাল সিং নামেই। বাবা প্রাক্তন মুখ্যমমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী শচীন্দ্রলাল সিং।। ত্রিপুরা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি খোলামেলা কথা বললেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে।
২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ফল এত খারাপ হল কেন?
আমাদের দলে ৫ জন বিধায়ক এসেছিলেন। তাঁদের ওপর রাগ, ক্ষোভে সমতল ও পাহাড়ের দলীয় কর্মীরা চলে গেল, আবার বিধায়করাও দল ছাড়ে। আমার হাতে যখন দায়িত্ব দিল তখন শূন্য। এদিকে নির্বাচনও চলে এল। তখন বিজেপির মারাত্মক ঢেউ। বাংলার মত দিল্লির সমস্ত মন্ত্রী রোজ ত্রিপুরা আসতে শুরু করল। বামফ্রণেটর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভও ছিল। আমরা আর্থিক বা সব দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলাম। মানুষ টের পেয়েছে বিজেপি ত্রিপুরার মানুষকে প্রতারিত করেছে।
একসময়ের সিপিএমের শক্ত ঘাঁটিতে সংগঠন গড়তে কি পদ্ধতি নিয়েছেন?
আমরা ফলো-আপ করছিলাম লেলিনের কথাটা। ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড। কারণ যখন আমার হাতে দায়িত্ব এল ২০১৭-এর ১ ডিসেম্বর তখন পার্টির শূন্য পজিশন। সেই সময় পার্টির সকলে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সংগঠনিক অনেক ক্ষেত্রে সিপিএমকে ফলো করছি।
বাংলায় ছোট-বড় শাসক-বিরোধী নেতারা অনেকেই নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া চলতে পারেন না। আপনি…..
আমি এখনও পর্যন্ত সিকিউরিটি নেইনি। উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা আমাকে ফোন করে নিরাপত্তা রক্ষীর জন্য। আমি তখন বলি আমার বাবা ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। আর আমি রাজ্য সভাপতি। আমাদের দলের কর্মীদের কেউ তো মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের নয়। তাঁদের নিরাপত্তা যখন দিতে পারবেন তখন আমাকে নিরাপত্তা দেবেন। আমার নিরাপত্তা ত্রিপুরার মানুষ।
রাজনীতির হাতেখড়ি কোথায়?
আমি বাংলায় রাজনীতি করে গিয়েছি। তখন ঘোর সিপিএমের জমানা। কলেজ লাইফ কলকাতায় কাটিয়েছি। পড়তাম গোয়ঙ্কা কলেজ অফ কমার্স। পরে ওখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে এলাম মোতিঝিল কলেজে। সেখানে সুভাষ চক্রবর্তী ও শান্তি ঘটকের দাপটে পার্টির কিছু ছিল না। পার্টি করতে ভয় পেত। আমি সেখানে ইউনিট তৈরি করলাম। আমাদের সঙ্গে লড়াই হত। সেটা ১৯৮৪-৮৬। টানা তিনবছর কলকাতায় ছাত্র রাজনীতি করেছি।
বংলার রাজনীতির অভিজ্ঞতা কেমন?
আমার ডাক নাম ছিল হনুমান সিং। সবাই হনু বলে ডাকত। ওই নামে সুভাষদাও ডাকতেন। শান্ত স্বভাবের ছিলাম। সুভাষদা আমাকে বলতেন, 'এগুলা কি করতাসিস। তুই আমার পোলাপানদের মারতাসোস। বোম-গুলি চালাইতাসো। মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে তুই।' আমি বলতাম, এখানে বাবা এসেছে! এখন তো বাবা মুখ্যমন্ত্রীও নেই। তাছাড়া আমি মুখ্যমন্ত্রীর পরিচয়ে এখানে রাজনীতি করছি না। তখন সুভাষদা বলতেন, 'এজন্যই তোকে ভাল লাগে। তুই বাঘের বাচ্চার মতো কথা কইস।'
বাবা দীর্ঘ দিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেদিক থেকে কোনও সুবিধা পেয়েছেন প্রভাবশালী রাজনীতিকের ছেলে হিসাবে?
বাবা ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭-এ নির্দল হয়ে লড়াই করে সিপিএম প্রার্থী নৃপেন চক্রবর্তী ও কংগ্রেস প্রার্থীকে হারিয়ে ছিলেন। আমি ২০১২ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস করছি। তার আগে কংগ্রেসে ছিলাম। আমি ত্রিপুরায় ছিলাম না। ১৯৮৬-এ প্রথম আসি। আমি তখন ছিলাম প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনের সার্কুলেশন ম্যানেজার। বাবা কখনও রাজনীতিতে এন্ট্রি দেননি। বাড়তি সুবিধা পাব বলে তিনি কখনও আমাকে সেই সময় রাজনীতিতে নামতে দেননি।
বিরোধী হয়েও অনেকেই শাসকদলের কাছ থেকে সুযোগ নেন।….
নৃপেন চক্রবর্তী আমাকে পুরো ত্রিপুরা ঘুরিয়েছেন। ব্যবসায় সাহায্য করবেন বলেছিলেন নৃপেনবাবু। আমার তখন বয়স কম ছিল ছিল। আমি ভেবেওছিলাম ভাল প্রস্তাব। কিন্তু বাবার নির্দেশ ছিল এসব একেবারে হবে না। আমাদের লোকেদের মারবে আর তোমাকে সাহায্য করবে তা হবে না। আমিও বুঝলাম একেবারে ঠিক। বিষয়টা উপলব্ধি করেছি। যদিও আমার পাহাড়ে যাওয়া অব্যাহত ছিল।
এখন ত্রিপুরায় তৃণমূলের সংগঠনের হাল কি?
৮ জেলাতেই কমিটি কাজ করছে। আমাদের সব কিছু করা ছিল। কিন্তু স্লো খেলতাম। বিজেপি ক্ষমতায় এসেই টার্গেট করল আমাদের কর্মীদের। আমাদের দলে কেউ যোগ দিলেই তাঁর ওপর ভয়ঙ্কর আত্যাচার করত। আমি তখন লেনিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করলাম ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড। আমার গাড়িও ভেঙেছিল। কর্মীদের প্রচন্ড মারল। তাই দলে যোগ দেওয়ার সময় কোনও প্রচার করতাম না। আমাকে কিছু করতে পারছে না। আমাদের কর্মীদের মারছে। সবাই ভেবেছে তৃণমূল শেষ। এটাই ভেবে নিয়েছে। চুপচাপ দলের সংগঠনের কাজ করে গিয়েছি।
মমতা ক্যারিসমা কতটা কাজ করবে ত্রিপুরায়?
বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের ফলের পরে দারুন উতসাহ এসেছে। ত্রিপুরার মাটিতে যখন দিদি ও অভিষেক পা দেবে তখন মানুষের ঢল দেখবেন। মমতাময় হয়ে গিয়েছে ত্রিপুরার মাটি। দিদির নামে নির্বাচন হবে। রাজ্যের মসনদে বিজেপি থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই। ২০২৩-এ ভোট। দেড় বছর বাকি থাকলেও কর্মীদের বলেছি ৮ মাস ধরে নিতে। তা নাহলে আত্মতুষ্টিতে ভুগবে।
কিসের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন…
প্রতি বুথে কমিটি চাই। রাজ্যের ৬০ শতাংশ বুথ কমিটি হয়ে গিয়েছে। ৩,৬০০ বুথ আছে। বুথ কমিটি না থাকলে কিছু করা যাবে না। আমি সিপিএমকে দেখেছি তো। আমি সিপিএমের সংগঠনেক ফলো করি। ১৬ অগাস্ট সারা ত্রিপুরায় খেলার গতি বাড়বে। প্রতি মহল্লায় ফুটবল দেব। ৬০টা কেন্দ্রে ৪টা করে ফুটবল দেব।
২০২৩-এর কৌশল কি?
২০১৪ সাল থেকে দাবি করে আসছি তৃণমূল ক্ষমতায় এলে আমরা উপজাতিদের মধ্য থেকে মুখ্যমন্ত্রী করব। আমি মুখ্যমন্ত্রী হব না। ত্রিপুরায় উপজাতিদের আসন রয়েছে ২০টা। আরও ৮টা আসনে জয়পরাজয় নির্ভর করে উপজাতিদের ওপর। ত্রিপুরার মোট ৬০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনই উপজাতি নির্ভর। ওই ভোট না পেলে জীবনে কোনওদিন সরকার গড়তে পারবে না কেউ। এটা আমার অঙ্কটা। তা নাহলে জোট করতে হবে। আমার কোনও লোভ নেই। আমি পার্টির সৈনিক হিসাবে কাজ করব আমি ভোটে প্রার্থী হব না। প্রার্থী হলে ফ্রি কাজ করতে পারব না। ভোটে দাঁড়ালে সেই মনসংযোগ থাকবে না। তাছাড়া জয়ের পর গ্রুপিং হবে, মন্ত্রী হতে চাইব।
যোগদান কেমন হচ্ছে?
২ মে যেদিন বাংলায় নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয়েছে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ৬০,৫৬২ জন তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে। সোমবার আমবাসায় যোগ দিয়েছে ১ হাজার জন। পরিবারের মাথাদের জয়েন করিয়েছি কোভিড বিধি মেনে।
দলে কারা আছেন?
এমবিএ, বিটেক ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, স্নাতকোত্তর, প্রফেসর, এরা দলের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে। ২৩-এ নির্বাচন আর পিকের ২৩ জন সদস্যকে 'ফেস' করতে পারছে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন