Somnath Chatterjee dies: বাবা ছিলেন হিন্দু মহাসভার সাংসদ, কিন্তু তিনি নিজে আজীবন কমিউনিস্ট রয়ে গেলেন। আজ, ৮৮ বছর বয়সে যখন ফিরে তাকান সোমনাথ চট্টোপাধ্য়ায়, অবশ্যই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তাঁর বিতাড়িত হওয়ার প্রসঙ্গটা সর্বাগ্রে উঠে আসেই। ২০০৮ সালের সেই অপসারণের পর কার্যত সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সোমনাথবাবু।
রবিবার সকালে নিজের বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে আড্ডার মেজাজেই ছিলেন সোমনাথবাবু, যাঁকে এখনো লোকসভার একমাত্র বাঙালি তথা কমিউনিস্ট স্পিকার হিসেবেই মনে রেখেছেন দেশবাসী। যে পদ নিয়ে দলের সঙ্গে বিবাদের সূচনা। মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বে ইউপিএ-টু সরকারের ওপর থেকে পরমানু চুক্তি ইস্য়ুতে সমর্থন প্রত্য়াহার করেছিল সিপিএম। কিন্তু সোমনাথবাবু স্পিকার হিসেবে আস্থা ভোট পরিচালনা করেছিলেন। জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-টু। দল লোকসভার অধ্য়ক্ষ পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বললেও তিনি সরেননি, এই যুক্তিতে, যে সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তিনি দায়বদ্ধ। তিনি সরলে সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তিনি অবিচল ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে। আজ তিনি বলেন, তাঁর ওই সিদ্ধান্তকে পরোক্ষে সমর্থন জুগিয়েছিলেন সিপিএমের একমেবাদ্বিতীয়ম কর্ণধার, প্রয়াত জ্য়োতি বসু।
অকপট সোমনাথবাবু বলেন, "জ্য়োতিবাবু আমাকে বলেছিলেন, আপনাকে বারণ করছি না। অর্থাৎ, আপনি আপনার কাজ করে যান।" তার আগে প্রকাশ কারাট ঘোষণা করেছিলেন দলের সিদ্ধান্ত, স্পিকার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। সোমনাথবাবু অবলীলায় সেই আদেশ অমান্য করেছিলেন। আজ বারেবারেই স্মরণ করেন, জ্য়োতিবাবু কীভাবে সবসময় তাঁকে পথ দেখিয়েছিলেন। "একবার কলকাতায় এসে জ্য়োতিবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম দেখা করতে। আমাকে দেখেই বললেন, কী এক্স-স্পিকার, কেমন আছেন? এ নিয়ে আমাদের মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি চলত।"
আরও কিছু বিষয় নিয়েও চলত, তবে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে নয়, বিজেপির সঙ্গে। একবার সংসদে বিজেপি নেত্রী এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সোমনাথবাবুর উদ্দেশে বলেছিলেন, "এন সি চট্টোপাধ্য়ায় আমাদের শ্রদ্ধেয়। ঘটনাচক্রে আপনি কমিউনিস্ট হয়েছেন। আসলে আপনি আমাদেরই লোক।"
Former Lok Sabha Speaker Somnath Chatterjee dies in Kolkata Hospital
এন সি চট্টোপাধ্য়ায়, অর্থাৎ সোমনাথবাবুর বাবা, ছিলেন হিন্দু মহাসভার সাংসদ। পর পর দুবার জয়ী হয়েছিলেন বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্র থেকে। ওই কেন্দ্র থেকেই প্রথমবার সাংসদ হয়েছিলেন সোমনাথবাবুও। বাবার সঙ্গে থেকে হিন্দু মহাসভার কাজ করেননি? সোজাসাপটা জবাব প্রাক্তন স্পিকারের। "হ্যাঁ, বাবা ভোটে লড়ছেন, কাজ করব না? তবে রাজনৈতিক ভাবে করিনি। বাবা নিজে আমাকে কাজ করতে বলেননি, আমিই উদ্য়ােগ নিয়ে করেছিলাম। ভোটের সময় জিপ ভাড়া করা, তার টাকাপয়সা মিটিয়ে দেওয়া, এসব আমি করেছি। লিফলেট ছাপানোর ব্য়াপারটাও আমার নজরে ছিল। কিন্তু একান্তই বাবা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন বলে।" যখন কমিউনিস্টদের দলে নাম লেখালেন, বাবা কিছু বলেননি? সোমনাথবাবুর জবাব, "না, আমি আমার মত করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আবার বলব, জ্য়োতিবাবু অামাকে গাইড করেছিলেন।"
একনিষ্ঠভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সেবা করেও শ্রদ্ধা, সন্মান পেয়েছেন সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে। যেমন কংগ্রেসের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল সোমনাথবাবুর। বিশেষ করে সোনিয়া গান্ধী আজও শ্রদ্ধা করেন তাঁকে। স্পিকার শুধু নয়, সোমনাথবাবুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধ্বে উঠে দেখতে চেয়েছিলেন অনেকেই। তার মধ্য়ে কংগ্রেস তো ছিলই। সোমনাথবাবু বলেন, "সোনিয়া গান্ধী চেয়েছিলেন আমি রাষ্ট্রপতি হই। তিনি নিজে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শিব সেনা, আকালি দল, জনতা দলের শরদ যাদবরা আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন আপনাকে সমর্থন করব। কিন্তু দল অনুমোদন করেনি।" দিল্লির রাজনৈতিক মহলে শোনা যায়, তখন প্রকাশ কারাট বলেছিলেন, কংগ্রেস না বললে আমি আগ বাড়িয়ে দলের পক্ষে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেব কী করে?
আরও পড়ুন: অবিনাশী মুক্তছন্দে বিপ্লবগাথা: নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানে ২৪-২৫ মে ১৯৬৭
সফল রাজনৈতিক জীবনে একটাই কাঁটা, ১৯৮৪ সালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৎকালীন আনকোরা কংগ্রেস প্রার্থী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের কাছে পরাজয়। তখন এই হারকে বলা হয়েছিল নক্ষত্রপতন। কেউ বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী হত্য়ার পরবর্তী সময়ে সৃষ্টি হওয়া সমবেদনার হাওয়ায় উড়ে গেলেন সোমনাথ। নানা ধরনের ব্য়াখ্য়া হয়েছে। মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের কাছে সেদিনের হার এখনও রাজনীতিতে চর্চার বিষয়। আজ ৩৪ বছর পর যাদবপুরে হারের আজ পর্যন্ত অজ্ঞাত একটি কারণ দিলেন অশীতিপর রাজনীতিক।
কী বললেন? "যাদবপুরের ছ'টি বিধনসভা এলাকায় আমি এগিয়ে ছিলাম। মাত্র একটি বিধানসভার ফল মমতার সঙ্গে আমার পার্থক্য় করে দিয়েছিল। কবিতীর্থে তখন নির্মল রায় বলে একজন দলের ভোট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। আমি বাকি সব কেন্দ্রে ডোর টু ডোর প্রচার করেছি। কবিতীর্থে প্রচারে যেতে নিষেধ করলেন নির্মলবাবু। তিনি বলেছিলেন, আপনাকে এই কেন্দ্রে আসতে হবে না। এখানকার মানুষ আপনাকে এমনি ভোট দেবে। এখান থেকে আপনি লিড পাবেন। আমিও তাঁর কথায় আশ্বস্ত হয়েছিলাম। সেখানে প্রচারে যাইনি। ওই কেন্দ্রের লিড নিয়ে আমাকে হারিয়ে দিল কংগ্রেস। শুধু ওই কেন্দ্রে আমি পিছিয়ে পড়েছিলাম ২৫,০০০ ভোটে। বাকি ছ'টা কেন্দ্রে কমবেশি এগিয়ে ছিলাম।" ১৯৮৪-র ওই নির্বাচন সোমনাথবাবু হেরেছিলেন ১৯,৬৬০ ভোটের ব্য়বধানে। আজ তাঁর আক্ষেপ, "আমার পরে মনে হয়েছিল কবিতীর্থের মানুষ আমার সেখানে প্রচারে না যাওয়াটা মেনে নেননি। প্রচারে না যাওয়াটা আমার ভুল ছিল। যেহেতু আগের নির্বাচনে সেখানে জয়ী হয়েছিলাম, তাঁদের ধারনা হয়েছিল আমার ঔদ্ধত্য জন্মেছে। সেই রাগে তাঁরা আমাকে ভোট দেননি।"
সেই হার ছাপিয়ে আজ বহুদূর এগিয়ে এসেছেন এই বর্ষীয়ান নেতা। সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে অনেক রাজনৈতিক সমীকরণ। তাঁর নিজের প্রাক্তন দলও আজ সঙ্কটে। সিপিএমের সংবিধান অনুযায়ী, একবার দল থেকে বিতাড়িত হলে কোন সদস্যকে ফেরানোর উদ্যোগ দল আর নিতে পারে না। বিতাড়িত সদস্যকেই দলে ফেরার আবেদন জানাতে হয়। যে আর্জি জানাবার আজ পর্যন্ত প্রয়োজন মনে করেননি সোমনাথবাবু। দল ডাকলে কী করবেন? ন'বারের সাংসদ বলেন, "না ডাকলে আমি কেন বলব? ডাকলে তখন দেখা যাবে।"