Advertisment

কেন গেরুয়া শিবিরের নজরে রামপুরহাট?

শনিবার রেলওয়ে চ্যাম্পিয়ন গ্রাউন্ডে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের জনসভা হয়, আর রবিবার সেখানেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের 'বিশ্ব শান্তি যজ্ঞ এবং হিন্দু সম্মেলন'।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

রামপুরহাটে আদিবাসীদের নিয়ে চলছে হিন্দু সম্মেলন

কেন রামপুরহাট? বারবার বীরভূমের এই শহর কেন সঙ্ঘ পরিবারের দিল্লীর নেতাদের নজরে? কেন নাগপুর থেকে সঙ্ঘ সেবকেরা বারবার ছুটে আসছেন এখানে? প্রশ্নগুলি ভাবাচ্ছে অনেককেই।
রথযাত্রা রামপুরহাট থেকে সাময়িকভাবে স্থগিত হলেও বিজেপি থামছে না, শনিবার তারা রেলওয়ে চ্যাম্পিয়ন গ্রাউন্ডে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের জনসভা করে, আর আজ রবিবার সেখানেই হচ্ছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের 'বিশ্ব শান্তি যজ্ঞ এবং হিন্দু সম্মেলন'।

Advertisment

পূর্বে তারাপীঠ আর হিন্দুদের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অসংখ্য গ্রাম পেরোলে মুর্শিদাবাদ, আর পশ্চিমে রুক্ষ এলাকায় পাথর খনি ক্রাশারের দাপট। আদিবাসীরা বড় সংখ্যায় থাকেন বিভিন্ন গ্রামে। কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গ্রামও এখানে, লাগোয়া ঝাড়খন্ড। আদিবাসীরা মূলত ক্রিশ্চান সম্প্রদায়ের। এই মাটি আঁকড়ে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবকেরা আদিবাসীদের মধ্যে নিরন্তর প্রচার চালাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে।

আরো পড়ুন: জিন্সের প্যান্ট-স্নিকার সহযোগে কীর্তন বীরভূমে, দেখা নেই রাম নামের

তাঁদের প্রচারের মূল স্তম্ভ - আদিবাসীরা আদতে হিন্দু, কিন্তু তাঁদের জোর করে ধর্মান্তকরণ করানো হয়েছে। তাঁদের উচিত নিজধর্মে ফিরে আসা। সেবকদের যুক্তি, আর্থিক দুরবস্থার কারণ "ভিন্ন ধর্মের" ব্যবসায়ীরা, যাঁরা তাঁদের জমি লুট করেছে, তাঁদের মহিলাদের "ভোগ্য" করে তুলেছে। অতএব হটাতে হবে এই "ভিন্ন ধর্মের" মালিকদের। হিন্দুধর্মের সম্মান অনেক, অনেক দেব দেবী, তাঁদের পুজো করলে করুণা লাভ সম্ভব। ধর্ম বদলালে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা, হোস্টেল, সব খরচ বহন করবে সঙ্ঘ বা তার কোনো শাখা, এমনটাই দাবি।

publive-image রামপুরহাটে রামচন্দ্রের মূর্তি

এই ধরনের ঘোষনায় আদিবাসীদের এক বড় অংশ বিভ্রান্ত হয়ে আছেন। পুজো-যজ্ঞ শেষে তাঁরা হিন্দু বলে ঘোষিত হন। প্রায় ১২ বছর আগে বাম জমানায় আদিবাসীদের ধর্মান্তকরণ নিয়ে তুমুল আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল, পুলিশের শীর্ষ পদাধিকারী, নেতা-মন্ত্রীতে ছয়লাপ হওয়া ভাটিনা গ্রাম জেনেছিল, ধর্মান্তকরণ বেআইনী কাজ। কিছু ধরপাকড়, পুলিসের অভিযানের পরে ভাটিনা গ্রামে সিংহবাহিনী মন্দির চত্ত্বর ফাঁকাই হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের ভয়ে এলাকা ছেড়েছিলেন ধর্মপ্রচারকরা।

বর্তমানে কিন্তু পুনর্মুষিক ভব। রাজ্যে-দেশে সরকার বদল হয়েছে, যাঁরা ধর্ম প্রচার করতেন তাঁরা আবার ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেছেন। ফলস্বরূপ ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ভাটিনার পরের গ্রাম খড়মাডাঙ্গায় ঢাকঢোল পিটিয়ে যজ্ঞ করে আদিবাসীদের হিন্দু করা হয়, এমনকি পুলিস নীরব দর্শক হয়ে সেদিন অনুষ্ঠানের দেখভাল করে। পরদিন রামপুরহাটে হিন্দু সমাবেশে প্রবীন তোগাড়িয়া, যুগল কিশোরের সঙ্গে এক বিভাজনের কথা বলেন আরএসএস, এমনকি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিনিধিরাও।

আরো পড়ুন: বীরভূম বিজেপির ঘরে কাজিয়া, পদ ছাড়লেন ৫৭ জন কর্মী

ফলে একদিকে জমি তৈরী করা, অন্যদিকে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান গড়তে এলাকার হিন্দু ব্যবসায়ীদের তাঁরা সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে একের বিরুদ্ধে এক হিসেবে বাম-বিরোধী জোট গড়তে এলাকায় নেতৃত্ব দেয় বিজেপি। খড়মাডাঙ্গা বা ভাটিনা যে গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে, সেই বনহাট গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে বিজেপি-তৃণমূল জোট। এরপর স্থানীয় প্রশাসক হিসেবে সংখ্যালঘুদের কার্যত থমকে দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব চালায় তারা। এবার যেহেতু ভোট হয় নি, তাই বনহাট পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে, কিন্তু পুরনো বন্ধুত্বের রেশ রয়ে গিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

খরমাডাঙায় এখন গিয়ে দেখা গেল, বিরাট দোতলা ভবন নির্মান হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্থানীয় নেতা দেবাশীষ চ্যাটার্জি জানিয়েছেন, নিচে গোশালা, ওপরে হোস্টেল নির্মিত হচ্ছে, আদিবাসী ছাত্রদের পড়ানোর এবং থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব তাঁরা নিচ্ছেন। পুজোপাঠ ধর্মাচরণ, এসবও হবে, তার জন্য রাম মন্দির নির্মিত হয়েছ। বলা বাহুল্য, ধর্মান্তরিত আদিবাসী পরিবারের সন্তানরাই পাবে এই সুযোগ।

publive-image নির্মীয়মাণ এই বাড়ির ওপরতলায় থাকবে হোস্টেল, নিচে গোশালা

স্থানীয় তৃণমূল নেতারা এই বিষয়ে কোন ভূল দেখতে পান না। তাঁরা পঞ্চায়েতের তরফ থেকে সমস্ত সহায়তা করছেন, এমনকি তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদ খরমাডাঙার মন্দির-হোস্টেলে যাতায়াতের জন্য বড় রাস্তা করে দিচ্ছে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে। দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রসাদ নামে এক সঙ্ঘকর্মী বলেন, "এটা সেবা কেন্দ্র হচ্ছে। আগে কমিউনিস্টদের সরকারের পুলিশ কাজ করতে বাধা দিত, এলাকায় থাকতে দিত না, এখন স্বাভাবিকভাবে কাজ চলছে।"

এই কথার সত্যতা বোঝা যায় এলাকায় ঘুরলেই। আগে ডিসেম্বরের শেষে বড়দিন উপলক্ষ্যে সেজে উঠতো গোটা এলাকা, প্রচুর ছোট-বড় গীর্জা ছিল আদিবাসীদের, যা সবই এখন প্রায় ভ্যানিশ।
প্রশাসনিক-রাজনৈতিক মদত প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, হিন্দুত্ববাদ তার শেকড় ছড়াচ্ছে গোটা এলাকায়।

আরো পড়ুন: বালি যেন সোনা, অজয়ের বুকে চলছে লুঠের সাম্রাজ্য

যাঁদের নিয়ে এত মাতামাতি, সেই আদিবাসীরা কী বলছেন? বন্ধু মুর্মু, রাম হাঁসদা, চুমকি সোরেন লাগোয়া এলাকায় থাকেন, তাঁরা বলছেন, "ওরা হিন্দু হলে এত কিছু সুবিধে দিচ্ছে তাই হিন্দু হচ্ছি। গঙ্গাস্নান করে যজ্ঞ করে মন্দিরে পুজো দিয়ে ধর্ম বদলাচ্ছি। বিজেপি তো আমাদের হিন্দুদের ভালো করছে।" আদিবাসী সংগঠনগুলো বিভক্ত নানাভাবে। একদা আদিবাসীদের মুখ ছিল আদিবাসী গাঁওতা। তাদের নেতা রবীন সোরেন বলেন, "আমরা বিষয়টা জানি, কিন্তু কোন বিরোধিতা করি নি কারণ কোনো সাড়া পাচ্ছি না আদিবাসীদের মধ্যে থেকে।"

অপর এক সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের নেতা মনসা হাঁসদার বক্তব্য, "আদিবাসীরা হিন্দু মুসলিম ক্রিশ্চান কোন ধর্মের নয়, আদিবাসীদের আর্থিক দুর্বলতা, অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে বিজেপি যে রাজনীতি করছে তাকে সরকারিভাবে মদত দিচ্ছে তৃণমূল। আমরা আদিবাসীদের কাছে গিয়ে বোঝাব এর বিপদ সম্পর্কে।"

রামপুরহাট বিধানসভায় বিজেপির অঙ্ক সঙ্গতভাবেই পরিষ্কার। তৃণমূল তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস পড়ছে বুঝতে পেরেও সম্ভবত নিজেদের ভোট রক্ষার্থে নীরব। ফলে বড়দিনের বাজারে আদিবাসীদের এলাকায় উড়ছে গেরুয়া পতাকা। সরকারী স্কুল থাকলেও তা খুঁড়িয়ে চলে। নেই কোন স্থায়ী কাজ বা আয়ের নিশ্চয়তা, অন্যদিকে সুখী জীবন আর সন্তানের ভবিষ্যতের হাতছানি। ধর্ম তাই এখানে উপলক্ষ্য মাত্র। সবটাই রাজনীতির উপকরণ।

tmc bjp VHP Birbhum
Advertisment