Rajmata Amrita Roy: একদিকে মার্কিন মুলুকের প্রাক্তন ব্যাঙ্কার আর উল্টোদিকে রাজবধু। কৃষ্ণনগরে লোকসভা নির্বাচনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্মৃতিধন্য কৃষ্ণনগরে সম্মুখ সমরে তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্র এবং বিজেপির অমৃতা রায়। মহুয়ার আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। তবে তাৎপর্যপূর্ণ হলেন বিজেপির প্রার্থী। তিনি নিজেই কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের বউমা।
৬৩ বছরের মহিলা অমৃতা রায় এবারই রাজনীতির আঙিনায় পা রাখছেন। কলকাতার লা মার্টিনিয়ার স্কুল এবং লরেটো কলেজের প্রাক্তনী এই রাজবধূ আগামী একমাস ভোটের প্রচারে ঘরের বউয়ের মতো মিশবেন সবার সঙ্গে। সম্প্রতি অমৃতাকে খোদ ফোন করে উৎসাহ জুগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কথা দিয়েছেন, বাংলা থেকে যত দুর্নীতির টাকা উদ্ধার করেছে ইডি, সবটা বাংলার প্রতারিতদের ফেরত দেওয়া হবে।
আবার উল্টোদিকে সুবক্তা, স্মার্ট-ঝকঝকে রাজনীতিবিদ মহুয়া মৈত্র সম্প্রতি টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছেন। সাংসদ পদও খারিজ হয়েছে তাঁর। বৈদেশিক মুদ্রা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তাঁকে তলব করেছে ইডি। তাঁর বাড়ি এবং দলীয় কার্যালয়ে তল্লাশিও চালিয়েছে সিবিআই। সবদিক থেকে যখন সাঁড়াশি চাপে মহুয়া, সেইসময় দল এবং দলনেত্রী আস্থা দেখিয়েছেন তাঁর উপর। কৃষ্ণনগরে ফের প্রার্থী করা হয়েছে তাঁকে।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ৬৩ হাজার ভোটে বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবেকে হারিয়েছিলেন মহুয়া। তাঁর আগে এই কেন্দ্রে দুবার সাংসদ হয়েছিলেন অভিনেতা তাপস পাল।
অন্যদিকে, কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সদস্য সৌমিশচন্দ্র রায়ের স্ত্রী হলেন অমৃতা। সৌমিশ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধর। রাজবাড়ির রাজমাতা বলে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। তবে আদতে কলকাতায় বড় হলেও হুগলির চন্দননগরের মেয়ে অমৃতা। তিনি বলেছেন, আমার পরিবারের অনেকেই পেশায় আইনজীবী। আমার পিতামহ সুধাংশু শেখর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত ক্রিমিনাল লইয়ার ছিলেন। আমার বাবা কিশোরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং কাকা শক্তিনাথ মুখোপাধ্যায়ও কলকাতার নামী উকিল ছিলেন।
বিয়ের আগে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন অমৃতা। তিনি বলেছেন, আমি কখনও ভাবিনি রাজনীতিতে আসব। কিন্তু যাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁর প্রস্তাব ফেলতে পারিনি। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেছেন, নদিয়া তথা বাংলার জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অবদান সবাই জানেন। আমাদের পরিবারকে সবাই চেনেন। আমার বিশ্বাস কৃষ্ণনগর আমাকে দুহাত ভরে আশীর্বাদ করবে।
আরও পড়ুন PM Modi: এবার শুধু বাংলার ‘প্রতারিত’দের অ্যাকাউন্টেই ঢুকবে টাকা! বড় প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী মোদীর
ইতিহাসবিদ স্বদেশ রায় কৃষ্ণনগরের রাজপরিবার নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। তাঁর দাবি, অনেকে বলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামে কৃষ্ণনগর নামকরণ হয়েছিল। কিন্তু এটা মিথ্যা। আসল নাম ছিল রেউই, বৈষ্ণব মতে গোপী বর্ণের মানুষদের বাস ছিল। শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের আধিক্য ছিল রেউই-তে। তার থেকেই জনপদের নাম হয় কৃষ্ণনগর।
অষ্টাদশ শতকে নদিয়ায় রাজত্ব ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের। জেলায় সর্বপ্রথম ১০ দিন ব্যাপী দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। কলা-সাহিত্যে অনেক অবদান রয়েছেন তাঁর পরিবারের। অন্নদামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর সভাকবি ছিলেন। শাক্ত পদাবলীর জনক রামপ্রসাদ সেনও কৃষ্ণচন্দ্রের স্নেহধন্য ছিলেন।
তবে ইতিহাস বলছে, বাংলা শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। মুঘল জমানায় বাংলার নবাবের অধীনে ছিল কৃষ্ণনগর। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নজর যখন বাংলার উপর পড়ে তখন ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান কৃষ্ণচন্দ্র, জগৎ শেঠ ভাইরা, মীরজাফর, ওমিচাঁদ, রায়দুর্লভ এবং বাকি সামন্তরা। পলাশীর যুদ্ধে তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই লর্ড ক্লাইভের বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হতে হয়ে সিরাজকে। সেইসঙ্গে পতন হয় স্বাধীন বাংলার। সেই ইস্যুকে হাতিয়ার করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং বিশেষ করে ক্লাইভের সঙ্গে, যিনি বাংলার গভর্নর ছিলেন। ১৭৬০ সাল পর্যন্ত মহারাজার সঙ্গে ব্রিটিশদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল, তারপর বাংলার নতুন নবাব মীর কাসিম তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। ক্লাইভ শুধু তা বাতিলই করেননি, কৃষ্ণচন্দ্রকে পাঁচটি ব্রিটিশ কামান, ‘মহারাজা’ উপাধি এবং কৃষ্ণনগরের জমিদারি উপহার দেন।
এটি উল্লেখ করে, তৃণমূল বুধবার এক্স-এ পোস্ট করেছে: “১৭৫৭: মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মীরজাফর, জগৎ শেঠ এবং ওমিচাঁদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং মেরুদণ্ডহীন বিশ্বাসঘাতকের মতো নিজেকে ব্রিটিশদের কাছে বিক্রি করেছিলেন… ২০২৪: 'রাজমাতা' অমৃতা রায়, তাঁর পরিবারের সদস্য , নির্লজ্জভাবে বাংলা-বিরোধী বিজেপিকে আলিঙ্গন করেছেন, আবারও বাংলার মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি চুক্তিতে সিলমোহর করেছে… মুখ বদলায় কিন্তু তাঁদের জমিদারি এখনও টিকে আছে… তাঁরা তখনও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না, এবং তাঁরা নিশ্চিত এখনও হবে না।"
অমৃতার মোদির কথোপকথনের কথা উল্লেখ করে, তাঁর কৃষ্ণনগরের প্রার্থীকে এই ধরনের অভিযোগের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার জন্য বলেছিল, বিজেপিও পাল্টা জবাব দিয়েছে। মহারাজার কর্মকাণ্ড আসলে "সনাতন ধর্মকে রক্ষা করার জন্য ছিল", বিজেপি জানিয়েছে, "ব্রিটিশ এবং সিরাজ-উদ-দৌলা উভয়ের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রজাকে রক্ষা করার জন্য এটা করেছিলেন"। রায় বলেন, মহারাজা যা করেছেন তা না করলে "আমরা আজ হিন্দু থাকতাম না"।