বছর ৬৫, ভাবে ভঙ্গিতে যদিও বয়স থাবা বসাতে পারেনি। তরতাজা যুবকের মতোই প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষটা। রাতের পর রাত জেগে ফুটবল দেখেন এখনও। ক্লাব বলতে বোঝেন রিয়াল মাদ্রিদ, দেশ মানে তাঁর কাছে শুধুই ব্রাজিল। আর প্রিয় ফুটবলার মার্সেলো, যাকে বলে ডাই-হার্ড ফ্যান। এমনটাই ইন্ডিয়া কাইটের অজিত দত্ত। আজও ব্রাজিল-সার্বিয়া ম্যাচে নেইমার-মার্সেলোর জন্য টিভি-র সামনে বসে পড়বেন কলকাতার অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ঘুড়ি নির্মাতা।
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার থেকে ডান দিকে যে রাস্তাটা সুইমিং পুলের দিকে ঢুকে যাচ্ছে, সেখানেই পরপর তিনটে ঘুড়ির দোকান। কলকাতা কাইট, বেঙ্গল কাইট এবং ইন্ডিয়া কাইট। শেষ দোকানটাই অজিত বাবুর। ভারত তথা সারা পৃথিবীতেই এরকম অনেক প্রবীণ নাগরিক রয়েছেন যারা রাত জেগে ফুটবল দেখেন। চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ বলে নয়, সারা বছরই তাঁরা টিভি-তে চোখ রাখেন। দেখেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। তাঁদের দলেই রয়েছেন অজিতবাবুও। কিন্তু বাকিদের চেয়ে তাঁর গল্পটা অবশ্যই আলাদা।
আরও পড়ুন:FIFA Football World Cup: বিশ্বকাপের হাত ধরে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা ঘর করে বাগবাজারে
আজ ৪০-৪৫ বছর ধরে ঘুড়ি বানাচ্ছেন তিনি। বিশ্বকাপের সময় নিজের সৃষ্টির হাত ধরেই ফুটিয়ে তোলেন আবেগ। ক্রিকেট হোক বা ফুটবল বিশ্বকাপ, অজিত বাবুর ঘুড়ি কথা বলে। হতে পারেন পেশায় ঘুড়ি নির্মাতা, কিন্তু তাঁর কাছে বিশ্বকাপের স্পেশ্যাল ঘুড়িগুলো সন্তানের মতো। ঘুড়ির কাঠি চাঁছতে চাঁছতে বললেন, "এ সব ঘুড়ি বিক্রির জন্য নয়। পাঁচটা মানুষ দোকানে এসে এগুলো দেখবেন, এটাই আমার ভাললাগা। খেলা ভালবাসি, এভাবেই নিজের ভাললাগাটা তুলে ধরি। বিশ্বকাপের যে ক'টা ঘুড়ি দোকানে আছে, সেগুলো পরে দরকার হলে বিক্রি করার কথা ভাবব।" বিশ্বকাপের জন্য ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, জার্মানির মত দেশের পতাকা-বাহী ঘুড়িই রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। এর মধ্যে আবার বেশ কয়েকটা ঘুড়ি নিজের কাছে রেখে দেবেন, কখনই বিক্রি করবেন না বলে মনস্থির করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: FIFA World Cup 2018: উত্তরের এই পাড়া যেন একটুকরো রিও
বরাবরই ব্রাজিলের ভক্ত অজিতবাবু। বলছেন, "আগে রোনাল্ডো-কার্লোস-কাকাদের খেলা ভাল লাগত। এখন নেইমার আর মার্সেলো রয়েছে। যদিও রোনাল্ডোদের দলটাকে মিস করি। কিন্তু কী আর করা যাবে! একটা সময়ের পর তো দল বদলে যাবেই।" দোকান ঘরেই খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছেন তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত খবরের কাটিংগুলো। গর্বের সঙ্গে সেগুলো বার করে দেখান। বিশ্বকাপের কথা উঠলেই একটু নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েন অজিতবাবু। ১৮ তম বিশ্বকাপের আসর বসেছিল জার্মানিতে। সেবছরের কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ইন্ডিয়া কাইটের কর্ণধারের। স্মৃতির সরণীতে দু’কদম হেঁটে তিনি বলছেন, "সবাই জানেন ২০০৬ বিশ্বকাপ বসেছিল জার্মানিতে। সেবার ইএসপিএন-এ খেলা শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগে আমার বানানো বড় একটা ঘুড়িই দেখানো হত।"
আরও পড়ুন: চা, রুটি বানানোর ফাঁকে হাল্কা ড্রিবলিং, সঞ্জীবও বলতে পারেন, রোনাল্ডোও
অবশ্য ২সি, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার এবং বিশ্বকাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন অজিতবাবু। আহমেদাবাদের আন্তর্জাতিক ঘুড়ি ফেস্টিভালেও নয়ের দশকে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। তাঁর বানানো চার্লি চ্যাপলিন ঘুড়িও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলার অভিনেতা রবি ঘোষ থেকে মুম্বইয়ের জনি ওয়াকার এবং আসরানিও তারিফ করেছেন তাঁর কাজের। তাঁদের হাত থেকেই বেশ কিছু পুরস্কারও নিয়েছেন তিনি।
এবং শুধু ঘুড়ির উৎসবে সামিল হওয়াই নয়, নিজের উদ্যেগেই কলকাতার ময়দান প্যারেড গ্রাউন্ডে আটের দশকে ডায়মন্ড কাপ, গোল্ড কাপ এবং নক-আউট লিগ কাপের মতো ঘুড়ির প্রতিযোগিতা আয়োজন করতেন তিনি। রথিন পালের লেখা 'ঘুড়ির কথা' বইতেও জ্বলজ্বল করছে অজিতবাবুর ইতিহাস। আজও ওয়েস্ট বেঙ্গল কাইট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি।