অক্সিজেন ছাড়াই বিশ্বের অন্যতম দুরূহ এবং উচ্চতম শৃঙ্গ জয়। এমনটাও সম্ভব? শ্যামবাজারের বাসিন্দা অরিজিৎ দে অবশ্য সেই অসম্ভবই সম্ভব করে দেখালেন। শৃঙ্গজয় তো এখন বার্ষিক উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অক্সিজেন ছাড়া? অনেক সফল পর্বতারোহীই দু-বার ভাববেন। বঙ্গসন্তান অবশ্য ভাবেননি। বেশ কয়েক বছর ধরেই লেগেছিলেন স্বপ্ন সফল করবেন। এর আগে দু-বার ব্যর্থ হয়েছেন। তবে হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত মানসলু পর্বত সফলভাবে অভিযান করলেন তিনি। কোনও সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ছাড়াই। প্ৰথম এশীয় হিসাবে তিনি আপাতত পর্বতারোহনের রেকর্ড বইয়ে উঠে গেলেন। এর আগে দু-জন মাত্র অক্সিজেন ছাড়া এমন নজির গড়েছেন। দু-জন'ই ইউরোপীয়।
পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বড়সড় অঙ্কের বেতন একাউন্টে জমা পড়ত মাস শেষে। নিশ্চুপ আরামের জীবনের সমস্ত উপকরণ নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার যাবতীয় মশলাই ছিল অরিজিতের কেরিয়ারে।
সেসব এখন অতীত। বিশাল টাকা বেতনের চাকরি ছেড়েছুড়ে তিনি আপাতত বেছে নিয়েছেন অস্থির জীবন। পর্বতারোহণ রক্তের প্রতি প্রবাহে। নেশা ছিলই। এবার সেই নেশাতেই জীবন পার করার জন্য অনিশ্চিত আগামীকে সাদরে বরণ করে নিয়েছেন কলকাতার অরিজিৎ।
ভারত এবং নেপাল হিমালয়ের ৬ হাজারের অধিকাংশ চূড়াই গত কয়েক বছরে আরোহণ করেছেন। ওটা ছিল সলতে পাকানো। বহু বছরই পাখির চোখ ছিল নেপালের সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট মানসলু (৮১৬৩ মিটার) অভিযান করার। সেই স্বপ্নের শিখাতেই তিনি আপাতত নেপালের অন্যতম উচ্চতম শৃঙ্গ জেতার কাছাকাছি।
মাউন্টেনিয়ারিং দুনিয়ায় ৮০০০ মিটার উচ্চতার বেশি পর্বতারোহণে রয়েছে অসম্ভব মৃত্যুর ঝুঁকি। ৮০০০ মিটার উচ্চতাকে তাই মাউন্টেনিয়ারিংয়ের পরিভাষায় ডেথ জোন ধরা হয়। এত উঁচুতে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে ভয়ঙ্কর কষ্ট হয় পাতলা বাতাসের জন্য। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের ক্ষেত্রে আইসফল ডক্টর, ওয়েদার রিপোর্টার, শেরপা, গাইড, কুক, হেল্পার, পোর্টার থাকে। আর আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কথা ভেবে অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ক্যারি করতে হয়।
সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ছাড়াই ঝুঁকিবহুল এই অভিযানকে পর্বতারোহণ-এর ভাষায় বলা হয় আল্পাইন স্টাইল।বহু পর্বতারোহী অতীতে এরকম অভিযানে গিয়ে স্রেফ হারিয়ে গিয়েছেন বরফের দেশে। হিমালয় পর্বতে অস্ট্রিয়ান হারমান বুল ছিলেন এই স্টাইলের অগ্রদূত। কোনও সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ছাড়াই নাঙ্গা পর্বত সফলভাবে অভিযান করেছিলেন তিনি। হাতে গোনা কয়েকজন মাউন্টেনিয়ারই সফলদের ব্র্যাকেটে নাম লিখিয়েছেন। এবার সেই দুর্গম পথের নেশাতেই ভারতের হারমান বুল হয়ে গেলেন অরিজিৎ।
এর আগে দু-বার মানাসলু অভিযানে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। গত বছরেই শৃঙ্গের কাছাকাছি পৌঁছেও বেস ক্যাম্প-এ ফিরে আসতে হয়েছিল। খরচ কমানোর জন্য কোনও শেরপাকে গাইড হিসেবে নেননি। ২৮ কেজির ব্যাগ একাই বয়েছেন।
কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে করে ধারাপানিতে পৌঁছেছিলেন। তারপর লারকে পাস, সামগাঁও হয়ে বেসক্যাম্পে পৌঁছেছিলেন। তারপর কয়েকদিন সারতে হয়েছিল অ্যাক্লাইমেটাজেশন। বা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। তারপরেই রওনা দিয়েছিলেন চূড়ান্ত শৃঙ্গ জয়ের জন্য। শেষমেশ ২৪ সেপ্টেম্বর বিকালে সফল অভিযান সম্পন্ন করেন।