Advertisment

বিসিবি-জেলা ক্রীড়া সংস্থার বলি শহীদ চান্দু, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অপূরণীয় ক্ষতি

বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন সমস্যা হিসাবে আবির্ভাব ঘটল বগুড়া স্টেডিয়াম

author-image
IE Bangla Sports Desk
New Update
NULL

রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ, বগুড়া, বাংলাদেশ

Advertisment

লম্বা সময় ধরেই ধুঁকছিল বগুড়ার শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম। ২০০৬ সালে নয়নাভিরাম স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা পেয়েছিল। এই স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বেশ কিছু সুখস্মৃতি রয়েছে। ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামেই হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এখানে একমাত্র টেস্টটিও হয়েছিল লঙ্কানদের বিরুদ্ধে। তারপর কেনিয়া-জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে খেলেছিল বাংলাদেশ। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের পর শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আর কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচ মাঠে গড়ায়নি। তবে শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামে বয়সভিত্তিক দল, নারী ক্রিকেট, জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল), বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) এবং ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচও হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের একমাত্র আন্তর্জাতিক ভেন্যু শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম।

এই অঞ্চলের ক্রিকেটপ্রেমীরা দীর্ঘদিন হলো স্টেডিয়ামটির আন্তর্জাতিক মর্যাদা ফেরানো এবং বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) আয়োজনেরও দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু স্টেডিয়ামটি বিসিবির সেভাবে দৃষ্টিগোচর হয়নি।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়ের পর বগুড়াকে নিয়ে বিসিবির মনোভাব বদল হতে শুরু করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ খেলতে রওনা হওয়ার আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দল শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে এক মাসের ক্যাম্প করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাউন্সি উইকেটের কথা মাথায় রেখে বগুড়াকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।

এই ক্যাম্প করার সুফলও পেয়েছিল আকবর আলির দল। বাংলাদেশে একমাত্র বগুড়ার উইকেট থেকেই যথেষ্ট বাউন্স পাওয়া যায়। এটাই দক্ষিণ আফ্রিকায় যুব বিশ্বকাপ জিততে দারুণ সহায়তা করেছিল অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে। এই সাফল্যে বিসিবি বাধ্য হয়েই বগুড়ার প্রতি নজর দিতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বগুড়ায় ‘বাংলাদেশ টাইগার্সে’র প্রথম অনুশীলন ক্যাম্পের আগে বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে যান। এরপর স্টেডিয়ামে ক্রিকেট সরঞ্জামাদি, ড্রেসিংরুমের আসবাবপত্রসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হয়।

ক্রিকেটের উন্নয়নের স্বার্থে বগুড়াকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা হাতে নেয় বিসিবি। যে কারণে শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামে একের পর এক ম্যাচ হচ্ছিল। কিন্তু ২ মার্চ হঠাতই বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) কাছে স্টেডিয়ামটি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বিসিবি। এনএসসি সচিব বরাবরে বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিজাম উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, "বিগত কয়েক বছর যাবৎ বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার অসহযোগিতার ফলে শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নিয়মিতভাবে টুর্নামেন্ট আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড স্টেডিয়ামটির রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায় দায়িত্ব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিকট হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ভেন্যুতে বিসিবির সকল কর্মকর্তা কর্মচারিদের ইতিমধ্যেই অন্য ভেন্যুতে বদলি করা হয়েছে।”

বগুড়ায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পাঠানো বিবৃতিতে পাল্টা অভিযোগ করেছেন সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন। তার দাবি, গত ১৬ বছরে বিসিবি এই স্টেডিয়ামে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করেনি। স্টেডিয়ামের সংস্কারও করেনি বরং বিসিবিই ‘অসহযোগিতা’ করেছে। গণমাধ্যমে মাসুদুর বলছিলেন, "স্টেডিয়াম বিসিবির নয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে এতদিন তারা ম্যাচ আয়োজন ছাড়াও তত্ত্বাবধান করতো। বিসিবি তাদের লোকজন রাখবে নাকি অন্যত্র নিয়ে যাবে সেটা তাদের বিষয়। তাদের সরিয়ে দেওয়া হলেও ম্যাচ আয়োজনে কোনো সমস্যা হবে না।”

জানা গিয়েছে, বিসিবির সূচি অনুযায়ী শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ কামাল জাতীয় যুব ক্রিকেট লিগের ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। বিসিবির তরফে এই সূচি আগেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১ মার্চ থেকে স্থানীয় প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ শুরু হবে বলে যুব ক্রিকেটের জন্য মাঠ দেওয়া সম্ভব নয়। এরপরই ক্ষুব্ধ বিসিবি বগুড়া থেকে সবকিছু গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে ক্রিকেটীয় সকল সরঞ্জামাদি ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিসিবির কর্মকর্তা কর্মচারিদের অন্যত্র পদায়নও করা হয়েছে। বগুড়ার ক্রিকেট সচেতনমহল মনে করছেন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা-বিসিবির দ্বন্দ্বে দেশের ক্রিকেটের যেমন ক্ষতি তেমনি বগুড়ার ক্রিকেটেও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। বগুড়ার সন্তান এবং দৈনিক কালবেলা’র স্পোর্টস এডিটর রানা হাসান হতাশ হয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন, “বিসিবি কেন হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিল বুঝতে পারছি না। যেখানে আমাদের মাঠের স্বল্পতা রয়েছে সেখানে এ ধরণের সিদ্ধান্ত ক্রিকেটের জন্য বিরাট ক্ষতি। তবে আমি যেটা জানতে পেরেছি, বিসিবি সিদ্ধান্ত নিতে নাকি বাধ্য হয়েছে! কারণ বর্তমানে বিসিবির রাডারে বেশ ভালোভাবেই ছিল শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম। তাই জেলা ক্রীড়া সংস্থা দায় এড়াতে পারে না।”

এরপর তিনি যোগ করেন, “একটা আন্তর্জাতিক ভেন্যু বাতিল, এটা তো হতে পারে না। জেলা ক্রীড়া সংস্থা অসহযোগিতা করে থাকলে তাদের সঙ্গে বসে বিষয়টা সুরাহা করা উচিৎ ছিল। আমি মনে করি এখনও এ বিষয়টি সুরাহা হওয়া সম্ভব। এ জন্য বগুড়া থেকে সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে অনুরোধ করবো তিনি যেন দ্রুতই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের একটা রাস্তা বের করেন।”

স্থানীয় প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (কোয়াব) বগুড়া শাখার সদস্য সচিব অধ্যক্ষ তানভীর আলম রিমন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন, "শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামে খেলা না হওয়ায় দেশের ক্রিকেটের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। একই সঙ্গে বগুড়ার ক্রিকেটের জন্যও। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের উইকেটে ন্যাচারাল বাউন্স আছে, যেটা বাংলাদেশের অন্য মাঠে নেই।"

"অনূর্ধ্ব-১৯ দল এখানে ক্যাম্প করে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্য যুব বিশ্বকাপ জিতেছে। এই মাঠ নিয়ে যখন বিসিবি বড় পরিকল্পনা করছিল ঠিক তখনই বিসিবি-জেলা ক্রীড়া সংস্থার দ্বন্দ্বের বলি হতে হলো শহীদ চান্দুকে। এখানে বিসিবিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্থানীয় সংগঠক যারা রয়েছেন বিশেষ করে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের ক্রিকেটের প্রতি সেই অনুরাগ না থাকার কারণেই এমনটি ঘটেছে।”

এরপর রিমন বলে চলেন, "তারপরেও আমি মনে করি এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। বিসিবি চাইলে আবারও শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ফেরাতে পারে এবং বগুড়াবাসীও সেটাই চায়।”

বগুড়া স্পোর্টস রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোস্তফা মোঘলও জানিয়েছেন, জেলা ক্রীড়া সংস্থার একরোখা মনোভাবই শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের জন্য কাল হলো। তিনি বলছেন, “এখানে দীর্ঘদিন হল, আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়-ই না। বিসিবির আন্তরিক চেষ্টারও ঘাটতি ছিল। তবে ক্রিকেটের স্বার্থেই বিসিবি নতুন করে বগুড়া প্রতি নজর দিয়েছিল। তারা স্টেডিয়ামটি নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। বিসিবির শীর্ষ কর্তারা স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে নতুন আরও ২টি সেন্টার উইকেট এবং অনুশীলনের জন্য নতুন করে আরও ৪টি উইকেট তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমের পুরাতন আসবাবপত্র সরিয়ে নতুন করে সাজানো হয়। দেয়া হয় ঘাস কাটার নতুন মেশিনসহ বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি।

এরপর মোস্তফা মোঘল যোগ করেন, "এতকিছু করার পর হুট করে বিসিবির স্টেডিয়াম ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অনেক দিন ধরেই জেলা ক্রীড়া সংস্থা স্টেডিয়ামকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। অনেকটা প্রভাব খাটিয়ে তারা এটা করে আসছিল। তাদের এই প্রভাব খাটানোকে বিসিবি ভালোভাবে নেয়নি। তাই তারা বগুড়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল। ফলে ক্ষতিটা হলো দেশের ক্রিকেটের, বগুড়ার ক্রিকেটের।”

cricket Bangladesh Cricket Bangladesh Cricket News
Advertisment