আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় বারপুজোর ব্যাপার থাকত। তবে সেটা ছিল মূলত ময়দান কেন্দ্রিকই। যবে থেকে ডিভিশন খেলা শুরু করলাম তখন থেকে বার পুজোর সঙ্গে আরও বেশি করে জড়িয়ে গেলাম। আমরা মোহনবাগানের ফ্যান ছিলাম। বার পুজোর দিন ভোর হতে না হতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম। প্রথমেই চলে আসতাম মোহনবাগান মাঠে। তারপর প্র্য়াকটিস শুরু করতাম, মাঠের এক ধারে প্র্যাকটিস করতাম, যেন ছোট হকি মাঠ। তারপর সেখানে বার পুজো হত। মোহনবাগান মাঠের বার পুজো হয়ে গেলে চলে যেতাম ইস্টবেঙ্গলে। ছোটখাটো সব ক্লাবেই কম-বেশি বারপুজো হত। যেহেতু ফ্যানেরা সব ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানেরই ছিল, সেজন্য ওই দুই ক্লাবেই বেশি ভিড়ভাট্টা হত। যদিও আগেই জেনে যেতাম যে, এবার নতুন কোন কোন খেলোয়াড়রা ক্লাবে সই করেছে, কিন্তু ওইদিন তাদের নিজের চোখে দেখার একটা আলাদা উন্মাদনা ছিল। বিশেষত ভিন রাজ্যের খেলোয়াড়দের দেখার আগ্রহ ছিল বেশি। এখনও মনে আছে তখন আমার বয়স ১২-১৪ বছর। ৭৯-তে জেভিয়ার পায়াস মোহনবাগানে আর ৮০-তে মজিদ বাসকর ইস্টবেঙ্গলে সই করেছিল। ওদের দেখার জন্য সেবার পয়লা বৈশাখের দিন মাঠ ভেঙে পড়েছিল।
ফ্যান হিসেবে বারপুজো একরকম। ফুটবলার হিসেবেও বার পুজোয় আবার অন্যরকম। যখন মোহনবাগানে সই করলাম তখন সকাল সাতটার মধ্যে প্র্যাকটিসে চলে যেতাম। কেডস পরে প্র্যাকটিস হতো তখন। মাঠে প্রচুর লোক আসত প্র্যাকটিস দেখতে। অমল দা (অমল দত্ত) আমাদের প্র্যাকটিস করাত। সেদিন প্র্যাকটিস বলতে সেরকম কিছু হত না। একটু ওয়ার্ম-আপ করতাম শুধু। গ্যালারিতে, মাঠের ধারে প্রচুর সমর্থক চলে আসতেন। এত মানুষ আসতেন যে, এখন সে সংখ্যাটা ভাবাই সম্ভব নয়। সকলে নতুন খেলোয়াড় দেখে হইহই করে উঠতেন। আনন্দে গা ভাসাতেন। অন্যদিন প্র্যাকটিসে দর্শকদের মাঠের মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্ত পয়লা বৈশাখের দিন সকলে মাঠের ভিতর চলে আসত সবাই। খেলোয়াড় থেকে অফিশিয়াল , কোচ সবাই এক হয়ে যেতন। এটাই ভাল লাগত। কোথাও কোনও অশান্তি হত না।
বার পুজোর দিন ক্লাবে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার থাকত। এটা অবশ্য এখনও আছে। ডাল-কচুরি,পান্তুয়া-বোঁদে-দরবেশ এসব থাকত মেনুতে। সেদিন আমরা এসবই খেতাম। এখনও এসব খাবার তৈরি হয়। ওদিন আর স্যুপ খেতাম না। ক্লাবের লনে সেদিন শামিয়ানা খাটানো হত, পুরনো খেলোয়াড়রা আসতেন। বার পুজো ঘিরে একটা মিলন উৎসবর আমেজ তৈরি হত!
আগের আর এখনকার বার পুজোর মধ্যে একটা বিস্তর ফারাক রয়েছে। আগে ক্লাবে প্রচুর মানুষ আসতেন পয়লা বৈশাখের দিন। এখন আর তেমন জনসমাগম হয় না। খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণেরও একটা বিষয় রয়েছে। আগে পয়লা বৈশাখ দিয়ে মরশুমের শুরু হতো। ফলে ক্লাবে সই করা নতুন সব ফুটবলারই ওদিন মাঠে হাজির থাকত, ক্যাপ্টেন তো থাকতই। এরপরেই কলকাতা লিগের টুর্নামেন্ট শুরু হত। এখন তো মরশুমে শেষে বারপুজো হয়। ফলে অধিকাংশ খেলোয়াড়কেই এই দিনে পাওয়া যায় না। আমার কাছে বার পুজো মানে শুধুই ক্লাবের মঙ্গলকামনা নয়, সমাজেরও। সবার জন্যই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় এদিন, শুধু ক্লাবের জন্য শুভকামনা নয়। একটা কথা এত বছর খেলাটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার পর মনে হয়, ফুটবলই পারে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের একটা বার্তা দিতে। বার পুজোর দিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় শামিল হন ভিন ধর্মের খেলোয়াড়রাও।
(অনুলিখন: শুভপম সাহা)