একটি লম্বা, মোটামুটি প্রশস্ত বারান্দা। দু'ধারে সার দিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন বয়সের মহিলা, নিজেদের কাজে মগ্ন। কথাবার্তা বেশি হচ্ছে না, শুধু মাঝে মাঝে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যেটুকু না বললে নয়। কী সেই কাজ? ফুটবল এবং ভলিবল তৈরির মহাযজ্ঞ। ঠিকই পড়লেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে চালু হওয়া 'জয়ী' প্রকল্পের অন্তর্গত এই যজ্ঞ, এ রাজ্যের মহিলাদের সেলাইয়ের স্বাভাবিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে।
একথা অজানা নয় যে ফুটবলার তৈরির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে পশ্চিমবঙ্গের নাম। তবে শুধু ফুটবলার তৈরিই নয়, অদূর ভবিষ্যতে ফুটবল বানানোর জন্যও রাজ্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে দেশে-বিদেশে। সব ঠিকঠাক চললে চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী দেশ জার্মানি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চিনও কথা বলবে ভারতের ফুটবল নিয়ে। বাড়ির মা-মেয়েদের তৈরি 'জয়ী' ফুটবলের হাত ধরেই বিশ্বায়নের নতুন রূপরেখা লিখতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ।
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে (তৃতীয় পর্ব)
দেখতে গেলে এ বাংলায় অতীতেও ফুটবল তৈরি হয়েছে। বছর ২০-২৫ আগেও ফুটবল শিল্পে প্রাণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা প্রায় বিস্মৃতির পথে চলে যায়। বাংলার ফুটবলটা চলে গিয়েছিল মূলত পাঞ্জাবের জলন্ধরে এবং আরও কয়েকটি জায়গায়। কার্যত রাজ্যের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প দপ্তরের একপ্রকার ঔদাসিন্যে এই রাজ্যে ফুটবল তৈরি শিল্পটা মৃতপ্রায় হয়ে যায়। ফুটবল তৈরি শিল্পের মরা গাঙে জোয়ার এসেছে এই বছর দুয়েক আগে। সৌজন্যে রিফিউজি হ্যান্ডিক্র্যাফটস, এবং অবশ্যই রাজ্য সরকার।
১৯৫০-এ ওপার বাংলা থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে এদেশে আসা মানুষ জীবিকার সন্ধানে রিফিউজি হ্যান্ডিক্র্যাফটস গড়ে তুলেছিলেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, সংগঠনটিকে সরকারি তকমা দেওয়ার। কিন্তু সেই মুহূর্তে তা সম্ভব না হওয়ায় বিধানবাবু তাঁদের মাথার ওপর একটি সরকারি বোর্ড গঠন করে প্রাণশক্তি সঞ্চার করেন। যদিও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে রিফিউজি হ্যান্ডিক্র্যাফটস ধুঁকতে থাকে।
এবার রাজ্যের প্রাক্তন ফুটবলাররাই উদ্যেগী হয়ে এই রাজ্যে ফুটবল তৈরির শিল্প প্রত্যাবর্তন করানোর পদক্ষেপ নেন। রাজ্য সরকারের সহযোগিতাকে মূলধন করে বাংলার ছয় প্রাক্তন ফুটবলার - মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসু, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, কম্পটন দত্ত, নিমাই গোস্বামী এবং শান্তি মল্লিকের ম্যানেজিং কমিটি এগিয়ে চলেছে। রাজ্যের শিল্প সচিব রাজীব সিংও এই প্রকল্পে সাহায্য় করেছেন।
আরও পড়ুন: ঘুড়ি নয়, যেন নিজের সন্তান, রাত জাগেন শুধু মার্সেলোর জন্য
স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়েই ফুটবল এবং ভলিবল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল প্রথমদিকে, তারকেশ্বরের ভীমপুর, হুগলির চন্দননগর এবং হাওড়ার রামরাজাতলায়। গত ২৬ মে থেকে এই প্রজেক্ট পা রেখেছে বর্ধমান জেলার বাগনাপাড়ার অন্তর্গত কেশবপুর গ্রামে, ওখানকার কেশবপুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে ফুটবল বানানোর কাজ। বিদেশ বোস নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে কাজের দেখভাল করছেন।
এই মুহূর্তে বাঘনাপাড়ায় গ্রাম বাংলার মেয়েদের বল বানানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন রঘুনাথ মুর্মূ, ইন্দ্রজিৎ পোরেল, এবং অতনু ধারা। ইন্দ্রজিৎবাবু দিল্লির গুড়গাঁওতে কাজ শিখে এসেছেন। অন্যদিকে অতনু ও রঘুনাথরা চন্দননগর এবং মানকুণ্ডু থেকে বল বানানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। গত মরসুমেও মহামেডানের হয়ে প্রথম ডিভিশন খেলেছেন রঘুনাথ। তিনি বলছেন, “প্রায় ২৩০ জন ট্রায়াল দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ১৮০ থেকে ২০০ জনকে আমরা বেছে নিয়েছি প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এরপর এখান থেকেই কারিগরদের তালিকা চূড়ান্ত হবে।" আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই ৪১০-৪৫০ গ্রাম ওজনের বল হচ্ছে এক একটি। ২৭-২৮ ইঞ্চি ব্যাস থাকছে। বল পিছু ৫০ টাকা করে পাবেন প্রতি কর্মী।
রাজ্যবাসীর জন্য আরও একটা গর্বের খবর শুনিয়েছেন বিদেশ-মানস। তাঁরা বলছেন, জার্মানির থেকেও ফুটবলের বরাত পেয়েছেন তিনি। এমনকী চিনা কনসুলেটও তাঁদের বল চেয়েছে। এছাড়া সাই-তেও রীতিমতো প্রশংসিত হয়েছে জয়ী। যুবকল্যাণ দফতর থেকে দেড় লক্ষ বল বানানোর বরাত তো রয়েছেই। সে কাজও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। গত বছর অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপের সময় রাজ্যজুড়ে ক্লাব ও স্কুলগুলিতে এই ফুটবল বিতরণ করা হয়েছিল। আপাতত 'জয়ী' হাওড়া, হুগলি এবং কলকাতাতেই পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে রাজ্যের ২৩টি জেলাতেই এই বল পাওয়া যায়, সেই দিকে চোখ থাকবে নির্মাতাদের।
ভাবলে অবাক হতে হয়, একেবার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা কী নিষ্ঠার সঙ্গেই এই বল বানাচ্ছেন। তাঁরা গ্রামের ছেলেদেরই ফুটবল খেলতে দেখেছেন। জীবনে হয়তো মেসি-রোনাল্ডো-নেইমারের নামও শোনেননি। কিন্তু তাঁদের বানানো বলই চলে যাবে বেকেনবাওয়ার-ন্যয়ারের দেশে। বল বানাতে বানাতেই খুকুমনি সরেন বললেন, তাঁরা এই বল বানানোর কাজটা খুবই উপভোগ করছেন। এটা ভেবেই তাঁর ভাল লাগছে যে, তাঁদের তৈরি বল বিদেশে গেলে সুনাম হবে এই রাজ্যেরই।