প্রয়াস রায় বর্মণ, গত ২৪ ঘণ্টা ধরে যাঁকে খুঁজেছে সারা দেশের মিডিয়া। নাগেরবাজারের বছর সতেরোর কিশোর চমকে দিয়েছেন আইপিএল-এর নিলামে। গত মঙ্গলবার জয়পুরে বঙ্গজ লেগ স্পিনারকে প্রায় দেড় কোটি টাকায় কিনে নিয়েছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। সব ঠিক থাকলে আগামী আইপিএল-এ বিরাট কোহলির সঙ্গেই মাঠে নামতে চলেছেন দুর্গাপুরে বেড়ে ওঠা এই ক্রিকেটার।
এবারের নিলামের আগে মূলত বাংলার তিন ক্রিকেটারই ছিলেন আলোচনায়। মহম্মদ শামি, ঋদ্ধিমান সাহা এবং মনোজ তিওয়ারি। এছাড়াও ঈশাণ পোড়েল, অভিমন্যু ঈশ্বরন, কণিষ্ক শেঠ, মুকেশ কুমার, বিবেক সিং এবং প্রয়াসের নামও উঠে এসেছিল।
আরও পড়ুন: IPL 2019: দেখে নিন খেলোয়াড়দের সম্পূর্ণ তালিকা
ঘটনাচক্রে দিন সাতেক আগেও কিন্তু প্রয়াসের নাম ছিল না নিলামে। বিসিসিআই সিএবিকে জানায় যে, প্রয়াসের বিষয় আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা। এরপরই বাংলা থেকে এই ছেলের নাম যায় বোর্ডের কাছে। বাকিটা ইতিহাস। নিলামে বাংলার ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকল প্রয়াস। বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি দাম পেয়েছেন শামি (৪ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা), এরপের ঋদ্ধি (১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা)। তিনে প্রয়াস। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে ফোনেই প্রয়াস জানালেন তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। কথা বললেন ক্রিকেট থেকে আইপিএল দর্শন নিয়ে।
এটা কি প্রত্যাশিত ছিল?
সত্যি বলতে, একেবারেই না। কোনও টিম যে আমাকে নেবে সেটা ভাবতে পারেনি। তাও আবার আরসিবি। আইপিএল-এর শুরুর দিন থেকে আমি ব্যাঙ্গালোরের ফ্যান। ফলোয়ারও বলতে পারেন। কারণ একটাই। আমার রোল মডেল বিরাট কোহলি খেলেন ওই দলে।
শেষ ২৪ ঘণ্টায় চারপাশটা কতটা বদলে গিয়েছে?
অনেকটা বদলে গিয়েছে। পাড়ার অনেকেই বাড়িতে এসে দেখা করে যাচ্ছেন। কেউ বলছেন মুখটা চেনা চেনা লাগছে। এখন আপনার সঙ্গে কথা বলার সময়ও ফোনে কল ওয়েটিং পাচ্ছি। কালকের পর থেকে কতগুলো যে ফোন পেয়েছি, গুনে বলতে পারব না। তবে আমার জীবন বদলাবে না। যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকব। এটা একটা বড় ব্রেক। অনেক কিছু শেখার আছে। আইপিএল-এর আগে বাংলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টেই আমার ফোকাস থাকবে।
প্রয়াস মূলত স্পিনার, কিন্তু নিলামে আরসিবি অলরাউন্ডার হিসেবেই নিল
এটা ঠিক যে আমি বলটাই বেশি করি। কিন্তু ব্যাটিংয়েও প্রচুর পরিশ্রম করি। ছোট থেকেই ব্যাটিং করছি। নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। বরাবরই নিজের বয়সের চেয়ে বেশি বয়সের গ্রুপেই খেলেছি।
প্রয়াসের কাছে বিরাটের জায়গাটা ঠিক কোথায়?
ছোট থেকে আমি শেন ওয়ার্নের ভক্ত। আইপিএল-এ ওয়ার্নের সঙ্গে দেখা হলেও টিপস নিতে চাইব। উনি তরুণ ক্রিকেটারদের অসম্ভব মোটিভেট করেন। কিন্তু এই মুহূর্তে বিরাট কোহলি আমার আদর্শ। উনি ইউথ আইকন। অনেক কিছু শিখতে চাই কোহলির থেকে। শুধু ব্যাটিংই নয়, ওঁর আগ্রাসন আর ভাবমূর্তি আমার দারুণ লাগে। এগুলোও শেখার আছে। তার ওপর ফিটনেসটাকে উনি অন্য পর্যায় নিয়ে গিয়েছেন। ফিটনেস নিয়েও টিপস নেব।
আরসিবি এত ভাল টিম করেও কেন চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না?
এটা আমিও একজন ফ্যান হিসেবে বহুবার ভেবেছি। দেখতে গেলে খাতায় কলমে অসাধারণ টিম আরসিবি-র। কোহলি থেকে শুরু করে গেইল, ডি ভিলিয়ার্সের মতো প্লেয়ারদের পেয়েও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। আমার মনে হয় ব্যাঙ্গালোরের ঘরের মাঠ চিন্নাস্বামী অনেকটা ছোট, ওখানে বোলাররা সেভাবে সুবিধা করতে পারে না। টিমের বোলিং ইউনিটটা আরও স্টেবল হওয়া দরকার।
কেরিয়ারের শুরু থেকে আইপিএল-এর যাত্রাটা কেমন?
আমি দুর্গাপুরেই বড় হয়েছি। দুর্গাপুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতাম। সেই সাত-আট বছর থেকেই খেলছি। বাংলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ খেলার জন্যই ২০১৫ থেকে কলকাতায় আছি। অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-২৩ খেলেছি। বিজয় হাজারেতে এবছর বাংলার হয়ে অভিষেক ম্যাচটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জম্মু-কাশ্মীরের বিরুদ্ধে চার উইকেট পেয়েছিলাম। গোটা টুর্নামেন্টে ১২টা উইকেট পাই।
টি-২০ ফর্ম্যাটে সেভাবে খেলা হয়নি, আইপিএল-এ মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে না?
আশা করছি হবে না। ওখানে যারা ফ্যাকাল্টি রয়েছেন, আর যেরকম টিম, প্রচুর শিখতে পারব। অন্যদিকে যুজবেন্দ্র চাহালের মতো একজন লেগস্পিনার রয়েছেন। যিনি ভারতের হয়ে খুব ভাল করছেন। আর আমাদের ক্যাপ্টেন অসাধারণ। উনি সবাইকে ভীষণ মোটিভেট করেন। প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়াই লক্ষ্য থাকবে। তারপর ম্যাচ বাই ম্যাচ ভাবব। দলের জন্য অবদান রাখতে চাই।
বাংলা থেকে কেন ক্রিকেটাররা উঠে আসছে না?
এ বিষয়ে আমার বলা সাজে না। আমি অনেকটাই ছোট। একটা কথা বলতে পারি, আমাদের ট্যালেন্টের অভাব নেই। কিন্তু ক্লাব স্তরে পরিকাঠামো আরও উন্নত হওয়া প্রয়োজন। তাহলেই ছবিটা বদলে যাবে।
প্রয়াসের উচ্চতা ৬ ফুট এক ইঞ্চি। ওয়ার্ন তাঁর আদর্শ হলেও, অজি কিংবদন্তির মতো বড় টার্ন নেই তাঁর। কিন্তু জোরে বল করেও নিখুঁত লাইন আর লেংথে বল রাখতে পারেন। এজন্য অনেকেই তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী অনিল কুম্বলে বলেও ডাকছেন। প্রয়াসের বাবা কৌশিক রায় বর্মণ পেশায় ডাক্তার। ছেলেকে বরাবরই ক্রিকেটে খেলায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি ছেলের জীবনটা এভাবে বদলে যাবে। শুধু বললেন, "বাবা হিসেবে অবশ্যই ভাল লাগছে। এই তো শুরু। কিন্তু রাস্তা অনেকটা লম্বা।''