মেরেকেটে দূরত্ব কয়েকশো মিটার। দেওয়ালে প্রলেপ পড়া নতুন এক বাড়িতে যখন গোটা গ্রাম উপচে পড়ছে। তখন, সামনেই নিজের বাড়িতে নিভৃতে অষ্টম দাস। সোমবার রাত থেকেই প্রবল মন খারাপ আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। বক্সিংয়ে হরিয়ানার ভিওয়ানি হোক বা হকির সংসারপুরের সঙ্গে একই আসনে যিনি কার্যত একার হাতে বসিয়ে দিয়েছেন অজ্ঞাতকুলশীল দেউলপুর গ্রামকে। জাতীয় স্তর হোক বা আন্তর্জাতিক একের পর এক সেরার সেরা ভারোত্তলক বেরিয়েছে যাঁর হাত ধরে।
সোমবার রাতেই বাড়ি ফিরেছেন কমনওয়েলথে বাংলার সোনার ছেলে অচিন্ত্য শিউলি। তার আগে থেকেই গোটা দেউলপুর জুড়ে ছিল সেলিব্রেশনের মেজাজ। মঙ্গলবার সমস্ত রং, উচ্ছ্বাস থেকে নিজেকে অন্তরালে সরিয়ে নিয়েছেন অচিন্ত্য শিউলির প্ৰথম গুরু অষ্টম দাস।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি ভীষণ অভিমান বুকে নিয়ে বলে দিচ্ছেন, "অসম্ভব খারাপ লাগছে। গতকাল রাত থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি সমস্ত আলোচনা থেকে। এয়ারপোর্টে সকলের সঙ্গে আমিও রিসিভ করতে গিয়েছিলাম অচিন্ত্যকে। তবে ও নামার পরে ওঁর ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারিনি। বাংলার অলিম্পিক সংস্থার কর্তারা, নেতা-মন্ত্রীদের ভিড়ে ওঁর কাছে পৌঁছতে পারিনি। আমাকে সরাসরি ওঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। ভেবেছিলাম অচিন্ত্য আমাকে খুঁজবে। কোথায় কী!"
প্রিয় ছাত্র অচিন্ত্য আজ রূপকথার এক নাম। বাবাকে অল্প বয়সে হারিয়ে, ভয়ঙ্কর আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দেননি। অচিন্ত্যর স্বপ্নের পিদিমে সলতে পাকিয়ে গিয়েছেন অষ্টম দাস। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হোক, বা জুতো কিনে দেওয়া, সীমিত আর্থিক সাহায্য নিয়ে বরাবরই পাশে দাঁড়িয়েছেন দেউলপুরের মহাগুরু।
তাঁর বিনিময়ে কী পেলেন! তিনি বলছেন, অবহেলা-অসম্মান আর বঞ্চনা। অষ্টম দাসের হাত ধরেই জ্যোতি মালের মত প্রতিভা উঠে আসা। সেই সময় ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস নাকি স্বয়ং অষ্টম দাসকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি এখনও দিনের মুখ দেখেনি। বারবার জুতোর শুকতলা খুঁইয়ে মন্ত্রী মশাইয়ের কাছে দরবার করেছেন, নিজের জন্য এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের, ভারোত্তোলনের নূন্যতম পরিকাঠামো। যেখানে তিনি আর বেশ কয়েকজন জ্যোতি মাল, অচিন্ত্য শিউলিকে তুলে আনতে পারবেন।
অচিন্ত্য শিউলিকে তার বাসভবনে গিয়ে সম্বর্ধিত করলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমবায় দপ্তরের মন্ত্রী অরূপ রায় (নিজস্ব চিত্র)
হতাশ গলায় গুরু অষ্টম বলছেন, "ক্রীড়ামন্ত্রীর দফতর থেকে আমাকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সুরজিৎ দত্ত, প্রদীপ বাবুর মত অফিসারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গিয়েছি। অরূপবাবু নিজেও চিঠি লিখে দেন। তারপরে বারবার গিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। শেষমেশ এরকমভাবে যাওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।"
মঙ্গলবারেও অরূপ বিশ্বাস হাজির হয়েছিলেন অচিন্ত্য শিউলিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য। তবে মন্ত্রী, সংবাদিক, উপচে পড়া গ্রামবাসীদের ভিড় থেকে সযত্নে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন অষ্টম দাস। ক্রীড়ামন্ত্রীর আধিকারিকদের তরফেও বারবার ফোন করা হলে আলোর মঞ্চে যাননি।
সোনার ছেলে অচিন্ত্যর দাদা অলোক শিউলিও ভারোত্তোলনে কোচ অষ্টমের ছাত্র। তবে অচিন্ত্যর সংস্পর্শে অলোককে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারির তরফে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই। তবে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে অষ্টম দাসের আশেপাশে। জানালেন, পাঁচলার স্থানীয় বিধায়ক গুলশান মল্লিকের তরফেও কোনওরকম সাহায্য জোটেনি।
শিষ্যরা জগৎজোড়া খ্যাতি নিয়ে আলোচনায়। তিনি আড়ালেই বেছে নিয়েছেন নিজের জীবন। বারবার দুঃখের সীমান্ত পেরিয়ে আজও নিজের প্রতিশ্রুতিতে অটল তিনি। বলছেন, "আমার সঙ্গে যতই বঞ্চনা হোক। কোচিং ছাড়ব না। আগামী দিনে আরও চ্যাম্পিয়ন তৈরি করব।"
বলেই নিজেকে লুকিয়ে নেন নিজের এক কামরার কুঠুরিতে। সমস্ত আলাপ, আলোচনা, প্রচারের লাইমলাইট থেকে বহু দূরে!