ফুটবল রোম্য়ান্সের মহাকাব্য লেখা হলে তাঁর নাম নিশ্চিতভাবেই প্রথম পাতায় জ্বলজ্বল করবে না। কোনওভাবেই মেসি, মারাদোনা, রোনাল্ডো, পেলে কিংবা বেকেনবাউয়ারদের রঙিন গোলার্ধের বাসিন্দা নন। প্রচার, প্রতিপত্তিতে তিনি পিছিয়ে কয়েক আলোকবর্ষে। তবে ব্যাপ্তি, প্রভাব বিচার্য হলে জর্জে লুইস বুরুচাগা সম্ভবত নিজস্ব পৃথিবীর একচ্ছত্র শাসক। যে দুনিয়ার থিম-ই হল, বিজয়ীকে প্রচারের আলো উপহার দিয়ে নিজে থাকো আড়ালে।
এবং কী আশ্চর্য মিল রাহুল শরদ দ্রাবিড়ের সঙ্গে! ক্রিকেট, ফুটবল- দুই খেলারই বহির্ভাগের সাজসজ্জা আলাদা, কিন্তু সার্বজনীন আত্মায় অবিশ্বাস্য মিল। দ্রাবিড়ের রাজকীয় আবির্ভাবের লাইম লাইট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামের বেহালার এক বাসিন্দা। তারপর গোটা কেরিয়ার জুড়েই এভারেস্ট-সম পারফরম্যান্স মেলে ধরেছেন দ্রাবিড়। তবে খ্যাতির চুম্বক টেনে নিয়েছে অন্য কাউকে। কখনও শচীন, সৌরভ কখনও আবার ধোনিকে।
(স্প্যানিশে সাক্ষাৎকার দিলেন কিংবদন্তি বুরুচাগা)
মারাদোনা যদি ফুটবলের শচীন হন, তাহলে রাহুলের ভূমিকায় ফুটবল বিশ্বে অবতীর্ণ বুরুচাগা। কেরিয়ারের শুরু থেকেই ভাগ্য দেবতা যেন ঠিক করে দিয়েছিলেন, নায়ক নন, পার্শ্বনায়ক হয়েই কাটাতে হবে তাঁকে। সেই ফর্মুলা মেনেই নিজের কক্ষপথ বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। ফুটবলের বাইবেল লেখা হলে মারাদোনাকে নির্ঘাত ঈশ্বর বানাবেন রচয়িতা। আর সেই ফুটবল-গ্রন্থে সম্ভবত ফুটনোটের মতোই লেখা হবে তাঁর নাম। অথচ ১৯৮৬-র ফাইনালে ৮৪ মিনিট না থাকলে মারাদোনা কোনওভাবেই 'মারাদোনা' নন। বিশ্ব ফুটবলে ট্র্যাজিক মহানায়ক হিসেবেই হয়তো বন্দিত হতেন কিংবদন্তি। ফুটবল কেরিয়ার বাদ দেওয়া যাক, কোচ হিসেবেও বা কি এমন প্রোফাইল! ১৪ বছরের কোচিং কেরিয়ারে দেশে দ্বিতীয়সারির কিছু ক্লাবে ম্যানেজার হয়েছেন। কিন্তু সিভি-তে অদৃশ্যই থেকে গিয়েছে জাতীয় দলের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা।
বিশ্বকাপে মেসিদের দলে বিদ্রোহ! সাম্পাওলির বিরুদ্ধে কার্যত সমস্ত ফুটবলাররা একজোট। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাসচেরানো, অ্যাগুয়েরো! চাইছেন দলের ম্যানেজারই হাল ধরুন। বিশ্বকাপে দেশকে কোচিং করানোর সুবর্ণ সুযোগ। পরিস্থিতি সামলে দিলেন কে? দলের ম্যানেজার স্বয়ং বুরুচাগা! ভাগ্যদেবতা যা লিখে দিয়েছেন, সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন কিংবদন্তি।
বিশ্বকাপের ঠিক পরেই সাক্ষাৎকারের আবদার জানানো হয়েছিল এন্টে রিয়ে-র বাসিন্দাকে। তবে সেইসময় বিশ্বকাপ হারের শোকে এতটাই মূহ্যমান ছিলেন যে, স্রেফ পারেননি! শোকের দাবানল অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে গত একবছরে। এবার কোপার মাস খানেক আগে ফের একবার 'নক' করা গেল '৮৬-র বিশ্বকাপে মারাদোনা-র ছায়াসঙ্গীকে। এবার পুরনো 'বন্ধু'-কে আর হতাশ করলেন না। রাতারাতি সাক্ষাৎকারে রাজি মহাতারকা। গোটা রাতের আলাপচারিতায় কিংবদন্তির গলায় কখনও নস্ট্যালজিয়া, কখনও আবার দার্শনিকতা-
ভালদানো, বুরুচাগা, মারাদোনা, পাসারেল্লা, নেরি পম্পিদো! ভয়ানক সমস্ত নাম। প্রতিপক্ষ নাকি রীতিমতো কাঁপতে কাঁপতে মাঠে নামত! কিন্তু এই প্রজন্মের হল কি! লিওনেল আন্দ্রেস মেসি ছাড়া নীল-সাদা জার্সিতে প্রত্যেকেই এত সাধারণ?
স্রেফ একটা বিষয়ে তফাত হয়ে গিয়েছে। সময়। প্রজন্মের হিসেবে দুই দল-ই দুরন্ত। সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমাদের সময় পরিস্থিতি অনেক শান্ত ছিল। ফুটবলের সঙ্গে উন্মত্ততার কোনও আপাত-সম্পর্ক ছিল না। মেনোত্তির আমল থেকেই আমাদের কেবল ফিফা র্যাঙ্কিং মাথায় রাখতে হত। ফুটবল আমাদের কাছে অফুরান জীবনের মতো, প্রাণবন্ত অথচ শান্ত ! আমাদের ফুটবলে জীবন-বোধ, মেসিদের থেকে অনেক আলাদা ছিল। এখন ফুটবলে দায়িত্ব, পাগলামি অনেক বেশি! সেই সময়ে ফুটবল খেলেও আমাদের হাতে অনেক সময় থাকত। জীবনের অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ ছিল। তবে এখন ফুটবলারদের নিজস্ব কোনও সময়-ই নেই।
ফুটবল সমুদ্রের মতো। জীবনে অনেক কিছু যেমন দেয়, আবার ফিরিয়েও নেয়। আমাদের সময়ের কথাই ধরুন। '৮৬ থেকে '৯০-এর মধ্যে একবার চ্যাম্পিয়ন, একবার রানার্স। আমাদের দেশের ফুটবলে নতুন ইতিহাস লেখা হয়েছিল। তারপর বেশ কিছু কারণে সেই ইতিহাস আমরা আর স্পর্শ করতে পারিনি। '৯৪-এ আমাদের স্কোয়াড দুর্ধর্ষ ছিল। '২০০২-এ টুর্নামেন্ট জেতার অন্যতম দাবিদার ছিলাম। তবে প্রথম রাউন্ডেই হেরে গিয়েছিলাম আমরা। তারপর ২০০৬ এল। ২০১৪-এ শেষবার আমরা ফাইনাল খেললাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত ছিল আমাদের।
বিশ্বকাপের পাতা ওলটালে, প্রত্যেকেই ১৯৮৬-এ গিয়ে একটা অবধারিত 'পজ' নেয়। স্রেফ মারাদোনা-র জন্যই নয়, বল পায়ে বিপ্লবের জন্যও। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম জার্মানি বিশ্বমঞ্চে আর এমনভাবে কখনও লাঞ্ছিত হয়নি। যতই ৩-২ ফলাফল হাড্ডাহাড্ডি দেখাক, বলা ভাল, আর্জেন্টিনার ম্যাজিকের সামনে সেদিন দাঁড়াতেই পারেননি রুমেনিগে, লোথার ম্যাথাউজরা। ৮৪ মিনিটে মারাদোনা যখন ম্যাজিক-পাস বাড়ালেন, কী মনে হচ্ছিল, বল জালে জড়াতে পারবেন?
বন্ধু, সে ছিল এক দুর্ধর্ষ অভিজ্ঞতা। মেক্সিকো-য় ফাইনালে পৌঁছে যাওয়ার পরে চ্যাম্পিয়ন যে আমরাই হতে চলেছি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। প্রত্যেকের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ছিল। আমরা সকলেই স্বপ্ন দেখি। কখনও কখনও সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়ে আমাদের জীবনে নেমে আসে, কখনও আবার হয় না। সেটাই হয়েছিল সেবার। মারাদোনা সহ আমাদের গোটা স্কোয়াড সাড়ে তিন বছর একসঙ্গে খেলে বিশ্বকাপ অভিযানে যাই। বিভিন্ন সিচ্যুয়েশনে খেলতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। মেক্সিকোয় শুরু থেকেই আমরা দুর্ধর্ধ মোমেন্টাম পেয়ে গিয়েছিলাম। মারাদোনা তো বটেই, বাকি দলটাও ছিল তুখোড়। মারাদোনা নিজের পাশে দারুণ দল পেয়েছিল।
ICC Cricket World Cup: ধোনির সাহচর্যে বিশ্বকাপে বাঙালি কিংবদন্তির নাতি, মরুদেশে রূপকথা অন্য ঋষভের
ফাইনালে জয় ছাড়া অন্য কিছু আমাদের মাথায় ছিল না। তবে আমরা জানতাম জার্মানরা নাছোড় প্রকৃতির হয়। প্রতিপক্ষ যেই হোক, সবসময়েই কঠিন লড়াই উপহার দেয়। আমাদের ম্যাচেও ঠিক সেটা হল। তবে জার্মানি ২-২ করে দেওয়ার পরেও দলের কেউ বিচলিত হয়নি। কারণ আমরা জানতাম, উইনিং গোলটাও আমাদের পা থেকেই আসবে। আর মোক্ষম সময়ে সেই পাস!!! আগে বহুবার বলেছি, ও-ই সোলো রান ছিল আমার কেরিয়ারের সবথেকে লম্বা দৌড়! পিটার ব্রিগেলকে কাটিয়ে দেওয়ার পরেই বুঝে যাই, শুম্যাখার আমার বল সেভ করতে পারবে না।
গোল করার পরে মাটিতে বসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। ফাইনালে জয়সূচক গোল করে বিশ্বকাপ চ্য়াম্পিয়ন করার পরে একজন ফুটবলারের কাছে প্রাপ্তি-র আর বিশেষ কিছু বাকি থাকে না। এখনও আমার ছাত্রদের বলি, নীল-সাদা জার্সি-র জন্য, দেশের জন্য, নিজে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠো। '৮৬-র সেই দিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত।
জর্জে বুরুচাগা আর দিয়েগো মারাদোনা- দুই মহাতারকার বন্ধুত্ব এখনও তুমুল আগ্রহের বিষয়। এতদিন পরে মাঠের বন্ধুত্বের ফর্মুলা আপনারা এখনও কাঁটায় কাঁটায় মেনে চলেন?
স্কোয়াডের প্রত্য়েকেই আমার ভাল বন্ধু। এই বন্ধুত্ব অতীতে ছিল, এখনও আছে, আগামীদিনেও থাকবে। তবে মারাদোনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাইরের তুলনায় মাঠের মধ্যেই 'স্পেশাল' ছিল। আসলে দু-জনের কিছু কমন পয়েন্টস ছিল। সত্যি কথা বলতে, রুগেরি, জিয়ুস্তি, পম্পিদো, ওলার্তিকোচিয়া কিংবা গ্যারের যতটা ভাল বন্ধু, মারাদোনার ততটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম না আমি। কার্লোস বিলার্দো আমাদের বলতেন, 'মাঠের মধ্যে সতীর্থদের আত্মীয়ের মতো ট্রিট করবে। নিজের ভাইয়ের চোখে দেখবে।' ৮৬-র স্কোয়াডের টিম বন্ডিং এই কারণে অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। খেলার সময়ে দিয়েগো বহু ক্ষেত্রে আমার উপর নির্ভর করত। একইভাবে আমি-ও। তবে আমি দেখেছি, মাঠে ও মাঠের বাইরে আমরা দারুণ সব মুহূর্ত কাটিয়েছি। আমার ও ওর বন্ধুত্ব বরাবর অন্য মাত্রায় বাঁধা ছিল।
কোপায় এবার সেই মেসি নির্ভর দল! তবে কোচ নতুন। কোচ লিওনেলে-র (স্কালোনি) অধীনে কিংবদন্তি লিওনেল (মেসি) দেশকে গর্বের মুকুট পড়াতে পারবেন?
সমর্থকদের আশা এবার দল চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরবে। নিজেদের সেরা খেলাটা উপহার দেবে দেশবাসীকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, দেশের ফুটবল একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। দেশের জার্সিতে পড়ে মাঠে নামা মোটেই সহজ বিষয় নয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়- যতবার-ই জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলাম, মারাত্মক ওজন আমাকে পিষে দিয়েছে। আসলে এটা প্রত্যাশার চাপ। রাশিয়া বিশ্বকাপের পরে কিছু নতুন মুখকে এই জার্সিতে প্রথমবার দেখা যাবে। তবে মেসির মতো বেশিরভাগ ফুটবলারই কিন্তু অভিজ্ঞ। ওকে নিজের সেরাটা দিতে হবে। তাছাড়া অ্যাগুয়েরো, ওটামেন্ডি, দিমারিও-রা রয়েছে। এই টুর্নামেন্টে সেই অর্থে ফেভারিট কোনও দল নেই। তবে আর্জেন্টিনার কাছে বড়সড় সুযোগ থাকছে। স্কোয়াডে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার ভাল ভারসাম্য রয়েছে আমাদের।
তারকা বিদেশিকে নিয়ে কর্তা-কোচের মন কষাকষি, চরম ডামাডোল ইস্টবেঙ্গলে
লিও মেসি ছাড়াও যাঁরা বর্তমানে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের সদস্য দি মারিয়া, হিগুয়েন, জাবালেতা, মাসচেরানো- প্রত্যেকেই বিশ্বফুটবলে এক-একজন সুপারস্টার। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এঁদের সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
আপনাকে আগেও বলেছি, গোটা দেশের ফুটবলই একটা ট্রানজিশনের মধ্যে রয়েছে। ইতিহাস সবসময়ে বলে, ফলাফল যাই হোক, নিজের সেরাটা দাও। মেসিরা সেটাই দেবে, বাকিটা স্বয়ং ঈশ্বর জানেন!
বিশ্বকাপে জাতীয় দলের আপনিই বকলমে 'বস' ছিলেন! টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার এই শোচনীয় অবস্থার কারণ কী? টুর্নামেন্টের মাঝপথেই তো গুজব রটে গিয়েছিল, দলের সিনিয়ররা মোটেই জর্জে সাম্পাওলি-র অধীনে খেলতে চাইছে না। বরং আপনাকেই দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিল। গোটা বিষয় আপনি কীভাবে সামলেছিলেন?
টুর্নামেন্টের মাঝপথে গোটা-এপিসোডটা জাস্ট আমাদের নড়িয়ে দিয়েছিল। মিডিয়াতে অনেক কিছু লেখা হচ্ছিল। আমাদের দেশের মিডিয়া ভয়ঙ্কর। ওরা দুটো জিনিস বোঝে, সাদা আর কালো। মাঝে স্রেফ আর কিছু নেই। আসলে এখনকার প্রচারমাধ্যম এতটাই শক্তিশালী যে মুহূর্তেই দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভিতরের খবর পৌঁছে যায়। রাশিয়াতে দলের অন্দরের এই খবরও চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। আসলে আর্জেন্টাইন দল খেললে ধরে নেওয়া হয়, দুনিয়ার সেরা ফুটবলাররা খেলছে। খুব খারাপ পারফরম্যান্স হলেও প্রত্য়াশা থাকে, অন্তত শেষ চারে দল খেলবে। তাই শুরু থেকেই এই পারফরম্যান্স কেউ মেনে নিতে পারেনি। ফুটবলে সাধারণত এমন ঘটনা ঘটেই থাকে। দুর্ভাগ্য, সমস্যা দলের সঙ্গী হয়ে যায় অনেকক্ষেত্রে, অপ্রত্যাশিতভাবে। আমাদের দলের ভিতরের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, কারণ, প্রত্যেকেই জেনে গিয়েছিল, কী হচ্ছে ড্রেসিংরুমে। সেটা আরও মানসিকভাবে আমাদের পিছিয়ে দেয়। ফুটবলাররা কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জিততে চেয়েছিল। যদিও মাঠে কোনওকিছুই আমরা ঠিক করতে পারছিলাম না। আমরা ভেবেছিলাম, আর্জেন্টিনা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলে বাকিদের উড়িয়ে দেবে। তবে দায়িত্ব এবং চরম চাপের কাছে ছেলেরা নুইয়ে পড়েছিল শেষ পর্যন্ত। রাশিয়ায় আমরা যে ফুটবল খেলেছি, তা আমাদের দুঃস্বপ্নেরও অতীত।
বিশ্বকাপে মেসিদের মেন্টর বুরু (ফিফা)
মেসি হয়তো সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তবে সেটা একান্তই ক্লাব পর্যায়ে। জার্সি বদলালেই মেসির সাফল্য মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। প্রায় নিত্যদিনই বিশেষজ্ঞ, পণ্ডিতরা একথা বলছেন সমস্বরে। মারাদোনা-ও একবার মেসির সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন। আপনি মেসি-কে কাছ থেকে দেখছেন। সমালোচনায় সত্যিই কী লিও আক্রান্ত হয়? আর এই অনন্ত, সর্বগ্রাসী চাপের মধ্যে নিজেকে কীভাবে
ঠিক রাখে?
আর্জেন্টিনা আসলে ফুটবল-বুভুক্ষু দেশ। এখানে সমালোচনার মাত্রাও কখনও কখনও সীমা ছাড়িয়ে যায়, নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। তবে আপনাকে এটা স্বীকার করতেই হবে, শেষ দশ বছরে আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা বিশ্বের সেরাদের ব্র্যাকেটে থেকেছে। মেসির ঘটনা অন্যরকম। ইউরোপে ওঁর ফুটবল-শিক্ষার পরে জাতীয় দলের জার্সিতে সুযোগ পেয়েছিল। ইউরোপে ঈর্ষণীয় সাফল্যে পেয়েছে। এই কারণে দেশের জার্সিতে প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে মেসিকে তুলনার স্ক্যানারে ফেলা হয়। তবে যাঁরা ওঁর ঘনিষ্ঠ, ওঁর কোচ, কিংবা এমন একজন যে ওঁর খুব কাছের, তাঁদের থেকে মেসিকে ভালভাবে কেউ জানেন না। ছোট্ট থেকে লিও-কে দেখছি। জানি, দেশের জার্সিতে মেসির অবদান কী, ও দেশকে ঠিক কতটা ভালবাসে।
আর সমালোচনার ক্ষেত্রে বাকিদের মতো-ই ও রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়। তফাত হল, ও খুব সমালোচনা হজম করে নিতে পারে। মিডিয়া থেকে দূরে একলা থাকা সবসময় প্রেফার করে। মেসি যেদিন জাতীয় দলের জার্সিতে চ্য়াম্পিয়ন হবে, সেদিন আমি-ই দুনিয়ার সবথেকে সুখী হব। ব্যক্তিগতভাবে আমার এবারে মনে হচ্ছে, মেসি দেশের হয়ে এমন কিছু জিততে চলেছে, যা আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি।
মেসির সঙ্গে সাম্প্রতিককালে কথাবার্তা হয়েছে আপনার? কোপার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি সারছে লিও?
রাশিয়া বিশ্বকাপের পরে মেসির কথা কোনও কথা হয়নি আমার। আমার মনে হয়, আপনার মতো বাকি সংবাদমাধ্যমের উচিত ওকে একা থাকতে দেওয়া। বিশ্বকাপের ঠিক পরেই ওঁকে বলেছিলাম কোপার জন্য মনোনিবেশ করতে। আসন্ন কোপা বাকি ফুটবলারদেরও পরীক্ষা নেবে। একটা ভাল খবর, বিশ্বকাপের কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড ছ-মাস পিছিয়ে গিয়েছে।
মেসির ব্যক্তিগত টার্গেট থাকে প্রত্যেক বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা। তবে এবারের হতাশা সুদে আসলে মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কোপা আমেরিকা রয়েছে। এটা বাকি ফুটবলারদের কাছেও বড় ভরসা। আগে বারবার বলেছি, মেসি আসলে একজন যোদ্ধা। ও দেশের জন্য ট্রফি জিততে মরিয়া। বার্সার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ব্যর্থ হওয়ার পর ও এখন বিশ্রামে রয়েছে। আমার মনে হয়। আটলান্টিক পেরিয়ে নিজের দেশে সাফল্যের অনন্ত খিদে নিয়ে মাঠে নামবে।
গৌরবের ইতিহাস নিয়ে সোনার গোলার্ধে, বিখ্য়াত দুই ক্লাবের সঙ্গে আলোচনা মোহনবাগানের
ফুটবলের ইতিহাস বলে লাতিন আমেরিকান স্টাইল মানেই জোগা বোনিতো, স্কিলের বিচ্ছুরণ, ফ্ল্যামবয়েন্ট-ফ্রি ফ্লোয়িং ফুটবল কিংবা হাই টেম্পো আক্রমণ। দৌড় আর পাসের সমাহার। ইউরোপের সেই ডায়রেক্ট ফুটবল তো দখল করে নিয়েছে তিকিতাকার পাসিং স্টাইল। কোথাও কী শেষ পর্যন্ত তিকিতাকার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকান ফুটবলকে মান্যতা দিল ইউরোপ?
একটাই কথা বলব, অনেকের মনে হতে পারে, আমি মজা করছি। তবে ঘটনা হল, বার্সেলোনার তিকিতাকা কিন্তু ফুটবল বিশ্বকে স্রেফ ধ্বংস করে দিয়েছে। পেপ গুয়ার্দিওলার আমলে ওরা যেটা করেছিল, সেটা ফুটবল ইতিহাসের আস্ত একটা প্যারাগ্রাফ লিখে দিয়েছে। ওদের ফুটবলটা আসলে অন্যদের পক্ষে খেলা সম্ভব নয়। যাঁরা এই স্টাইল নকল করে, তাঁরা আসলে ফুটবলটা খেলার চেষ্টা করে যায়।
১৯৮৪-র নেহেরু কাপে খেলতে আপনি ভারতে এসেছিলেন। কলকাতা-পর্ব কী মনে পড়ে ব্যস্ত শিডিউলের মাঝে?
ভারতে গিয়েছি অনেক দিন হল। তবে প্রতিটি মুহূর্ত স্মরণে রয়েছে এখনও। কলকাতায় সেই সময় একটা টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলাম (নাম মনে নেই)। সেই সময় মাদার টেরেসা-র সঙ্গে সাক্ষাৎ। উনি সেই টুর্নামেন্টের কিক-অফ করেছিলেন এখনও মনে রয়েছে। আসলে বিলার্দো সবসময়েই চাইতেন আমরা নতুন নতুন ঘটনার সাক্ষী হই। নতুন জায়গার ফুটবলে অংশ নি-ই। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা আর মাদারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে- সবমিলিয়ে ভারত-সফর অবিস্মরণীয় ঘটনা ছিল আমাদের জীবনে। বহুদিন ইচ্ছে ছিল এমন একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব, যিনি মানবিক মূল্যবোধ, জীবনের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন আজীবন। মাদারের মতো যোদ্ধা বিশ্বে এখনও বিরল। ৩৫ বছরেরও বেশি কেটে গিয়েছে, তবে উনি যা বলেছিলেন আমাদের, তা এখনও স্মরণ করতে পারি। উনি আসলে একজন বিদ্রোহিনী, যিনি ভারতকে কঠিন সময়ে অনেক শিক্ষার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সেই ট্যুর ছিল পুরোপুরি মাদার টেরেসার জন্য।
ছাত্র রোহিতের চোটে স্বপ্নপূরণ পুত্র সিদ্ধেশের, দোলাচলে কোচ
আপনার পুত্র মাউরো তো একজন উঠতি ফুটবলার! সিরি-এতে চিয়েভো ভেরোনার সিনিয়র দলেও সুযোগ মিলেছে। মেন্টর পিতা-র কাছ থেকে কী শিখছে?
ফুটবলারকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া পুরোপুরি ওর সিদ্ধান্ত। আমি স্রেফ ওকে বুঝিয়েছিলাম, সময়ে সময়ে ফুটবল জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা নেয়। এই কেরিয়ার জীবনকে বহু ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে। বারবার ওকে বুঝিয়েছি, 'জীবনে যে কেরিয়ার-ই বেছে না-ও না কেন, তোমাকে প্যাশনেট হতে হবে। পাগলের মতো ভালবাসতে হবে সেই পেশাকে। বাবা হিসেবে প্রতিদিন তোমার পাশে থাকব, সমালোচনা করব, উৎসাহ দেব, সমর্থন করে যাব।' তবে পজিটিভ বিষয় হল, ফুটবল খেলাকে মাউরো সত্যিই ভালবাসে। যেটা করে সেটা মন দিয়েই করে ও। এটা বড় ব্যাপার। গত এক বছর ধরে ইতালিতে রয়েছে ও। উৎসাহ নিয়ে খেলে। ফুটবলের শারীরিক বিষয় এবং টেকনিক্যাল স্কিল বিচার করলে নিরপেক্ষভাবে বলতে পারি, ও-র মধ্যে বড় ফুটবলার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আপাতত সুন্দর এই খেলা প্রতি মুহূর্তে এক্সপ্লোর করতে ব্যস্ত মাউরো। (কনিষ্ঠ পুত্র রোমান আবার পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়)
দেখুন আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করা বুরুচাগার সেই দুর্ধর্ষ গোল
(পালটা প্রশ্ন) আপনি তো এতক্ষণ আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। এবার আপনি বলুন। ভারতীয় ফুটবলের মান শুনেছি, বেশ উন্নত হয়েছে, আগের থেকে। আমার এক বন্ধু সম্প্রতি ভারতের ফুটবলে কোচিং করানোর কথাও বলেছেন। ওখানকার চ্য়াম্পিয়নশিপের বিষয়ে কিছু জানতে চাই।
সবিনয়ে কিংবদন্তিকে জানানো গেল, ভারতের ফুটবলে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া লেগেছে অনেকটাই। আইএসএল-এ প্রবাদপ্রতিম তারকারা অংশ নেওয়ায় বহির্বিশ্বে স্বতন্ত্র পরিচিতও তৈরি হয়েছে।
কিংবদন্তি কি ভারতে আসবেন, ফের একবার নস্ট্যালজিয়ায় দুলিয়ে যাবেন ফুটবল-প্রেমীদের? অপেক্ষা কিন্তু রইল।