ক্রিকেট চলবে, দৌড়োদৌড়ি লাফালাফি চলবে না

"পায়ের মুভমেন্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘাসেই দৌড়তে হবে। আর আমাদের স্পাইক ঘাসের ক্ষতি করবে, ক্রিকেটারদের স্পাইক করবে না?"

"পায়ের মুভমেন্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘাসেই দৌড়তে হবে। আর আমাদের স্পাইক ঘাসের ক্ষতি করবে, ক্রিকেটারদের স্পাইক করবে না?"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
ক্রিকেটের জন্য মাঠে প্রবেশাধিকার নেই, গ্যালারির সিঁড়িই অ্যাথলিটদের অবলম্বন

ক্রিকেটের জন্য মাঠে প্রবেশাধিকার নেই, গ্যালারির সিঁড়িই অ্যাথলিটদের অবলম্বন (এক্সপ্রেস ফোটো: দীপক যোশী)

শৈশবের পাঠ্যপুস্তক থেকে এই দেশের স্কুল পড়ুয়ারা কম-বেশি একটা বিষয় জেনে এসেছে। ভারত একটি নদীমাতৃক ও কৃষিভিত্তিক দেশ। কিন্তু ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে ভারতের একটা অন্য ব্যাখ্যাও দেওয়া যায়। ধোনি-কোহলির দেশ ক্রিকেট কেন্দ্রিক ও বাণিজ্য ভিত্তিক। এখানে ক্রিকেট একটা ধর্ম। বাইশ গজের কথা মাথায় রেখে ও সুদূরপ্রসারী ভাবনার স্বার্থেই বলিপ্রদত্ত হচ্ছে দেশের অনান্য খেলা বা ‘আদার স্পোর্টস’।

Advertisment

স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছে দেশের আগামী প্রজন্ম। উঠতি অ্যাথলিটদের ট্রেনিং গ্রাউন্ডের দখল নিয়েছে ক্রিকেট। যেমনটা হয়েছে দাদোজি কোণ্ডদেও স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করা অ্যাথলিটদের। মহারাষ্ট্রের থানেতে নবরূপে সজ্জিত স্টেডিয়ামের দরজা এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাদের জন্য। 

এই ঘটনার অন্যতম সাক্ষী অদিতি পরব। এই মাঠে ১৬ মাস ট্রেনিং নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ রিলেতে (৪x১০০ মিটার) খেলো ইন্ডিয়ার স্বর্ণপদক ছিনিয়ে এনেছে অদিতি। নিজের চোখের সামনে এই মাঠের ঘাস বেড়ে উঠতে দেখেছে সে, আর আজ তাকে মাঠেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ অদিতির জুতোর স্পাইকে টার্ফ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ এখানে গ্রীষ্মকালীন ক্রিকেটের ভরা আসর অপেক্ষা করছে।

গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা, অদিতিকে প্র্যাকটিসের জন্য মাঠেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। স্টেডিয়ামের গেট থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অদিতিকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখানে সিকিউরিটি ড্রিল চলছে। কারণ সামনেই মারাঠি অভিনেতাদের একটি সেলিব্রিটি ক্রিকেট ম্যাচ রয়েছে। পাশাপাশি আইপিএল টুয়েলভের সময় একাধিক দলের কাছে কোণ্ডদেও স্টেডিয়ামই হয়ে উঠবে ট্রেনিং গ্রাউন্ড।

Advertisment

আরও পড়ুন: মোদীর রাজ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কত দূর হল কাজ!

গত এক বছরে ২০০-র ওপর তরুণ ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিটদের কাছে এই মাঠ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। মাঠে ঢোকার অনুমতি মেলে না তাদের। ফলে তারা বাধ্য হয়ে স্ট্যান্ডের সিঁড়িতেই প্র্যাকটিস করে। কেউ কেউ আবার টপ টিয়ারে। অথচ এই মাল্টিপারপাস স্টেডিয়াম শেষ তিন দশক ধরে একাধিক আন্তঃক্লাব দিবা-রাত্র অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করে এসেছে। এখন অ্যাথলিটদের জায়গা হয়েছে গ্যালারিতে। অদিতির ক্লাবের সতীর্থ নন্দিনী কাসকর গ্যালারির লোয়ার-টিয়ারের সিঁড়িতে লং-জাম্প প্র্যাকটিস করে। কিন্তু লং-জাম্পের পিটটাও ক্রিকেটের গ্রাসে চলে গিয়েছে। ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য ওই জায়গাটাই লং-অন হবে।

স্প্রিন্টারদের জন্য তড়িঘড়ি একটা এক লেনের গর্তে ভরা ২০০ মিটারের ট্র্যাক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে ট্র্যাকে প্র্যাকটিস করার ফলে পায়ের সমস্যা হচ্ছে অ্যাথলিটদের। বাবা-মা’র সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গিয়েছে। শুধু পায়ের যন্ত্রণাই নয়, কারোর কারোর পায়ে চিড়ও ধরেছে। অদিতি বলছে, "কংক্রিটের ট্র্যাকে দৌড়ে আমার পায়ে লাগে। আমি কৃত্রিমের বদলে প্রাকৃতিক সারফেসে প্র্যাকটিস করতে পারলে রিলে-তে নয়, ব্যক্তিগত বিভাগেই পদক জিততে পারতাম।”

দশ বছর বয়স থেকে প্র্যাকটিস শুরু করা অদিতি বোঝে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সারফেসের কত’টা ফারাক আর কী গুরুত্ব। অদিতি স্পাইকের ইস্যুতেও প্রশ্ন তুলেছে। সে বলছে, “কংক্রিটের ট্র্যাকে ট্রেনিং করে আমরা প্রায়ই চোট আঘাত পাচ্ছি। পায়ের মুভমেন্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘাসেই দৌড়তে হবে। আর আমাদের স্পাইক ঘাসের ক্ষতি করবে, ক্রিকেটারদের স্পাইক করবে না? আমাদের আর অন্য ট্র্যাকও নেই।”

অদিতি আসলে একজন ১০০ মিটার রানার। কিন্তু সে বলছে একটাই ওয়ান লেনের ২০০ মিটার ট্র্যাক। কিন্তু ১০০ মিটারে দৌড়ানোর জন্য় তাদের স্ট্রেইট ট্র্যাকই প্রয়োজন। ২০০ মিটারে ট্রেনিংয়ের সময় তারা বুঝতে পারছে না, কোথায় শুরু করে কোথায় গিয়ে গতি বাড়াতে হবে।

অন্য এক অ্যাথলিট ইশা রমতেকরের মা বললেন, “আমরা ক্রিকেটের বিরুদ্ধে নই। আমারা ক্রিকেটের নেটের সঙ্গে এই মাঠ ভাগ করেছি। আমি বলতে চাই ক্রিকেটাররা বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ট্রেনিং করুক। আমাদের ছেলেমেয়েরা পরের দিকে আসুক। প্রথমে আমাদের বলা হয়েছিল, মাঠের সংস্কার হবে। কিন্তু এখন আমাদের ঘাসে  পা রাখতেই দেওয়া হয় না।” এখানেই শেষ নয়, অভিভাবকদের আরও অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, পানীয় জলের জন্যও তাঁদের আবেদন করতে হয়। এমনকি মহিলাদের শৌচাগারও আর পরিচর্যা করা হয় না আগের মতো।

মিনাল পালান্ডে, স্টেডিয়ামের স্পোর্টস অফিসার ইন চার্জ জানাচ্ছেন, এই মাঠ থানে পুরসভার। আটের দশকে মাল্টিপারপাস স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে। তিনি বললেন, “সঞ্জয় জয়সওয়ালের উদ্যেগে পুরসভা এই মাঠের জন্য ৩.২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে বারমুডা ঘাস এনে লাগানো হয়েছে। অ্যাথলিটদের স্পাইকে ঘাস নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কলকাতা নাইট রাইডার্স জানিয়েছে, ওরা এখানে ট্রেনিং করবে। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরও খোঁজখবর নিয়েছে। বিরাট কোহলির ম্যানেজার নিজে ফোন করে এই মাঠের সুযোগ সুবিধা জানতে চেয়েছে।”

পালান্ডে নিজে প্রাক্তন কবাডি খেলোয়াড়। সেলিব্রিটি ম্যাচের নিরাপত্তার কারণে স্টেডিয়ামের গেটে তালা ঝোলানোর আগে বললেন, "এই মাঠ ওয়াংখেড়ের থেকেও বড়। আটের দশকে শচীন তেন্ডুলকর এখানে রঞ্জি খেলেছে। অস্ট্রেলিয়ার ঘাস আর স্প্রিংকলার সিস্টেমের জন্য ৩.২৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এটা থানের সম্পদ।"