Advertisment

‘আমি  প্রত্যেক বলে চার মারার কথাই ভাবছিলাম শুধু’

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে দীনেশ কার্তিকের অনবদ্য ইনিংস নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে সর্বত্র। রবিবাসরীয় কলম্বোতে লাইমলাইট কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। ভারতের প্রায় হারতে বসা ম্যাচ একা হাতেই জিতিয়ে দিয়েছিলেন কার্তিক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে দীনেশ কার্তিকের অনবদ্য ইনিংস নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে সর্বত্র। রবিবাসরীয় কলম্বোতে লাইমলাইট কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। ভারতের প্রায় হারতে বসা ম্যাচ একা হাতেই জিতিয়ে দিয়েছিলেন কার্তিক। তাঁর ৮ বলের ২৯ রানের ঝোড়ো ইনিংস চোখে লেগে আছে সবার। শেষ বলে ছয় মেরে দেশকে ফাইনাল জেতানোর মুহূর্তটাও ভুলতে পারছেন না কেউই। সেদিনের ওই ইনিংসের পর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় ধরা দিলেন কার্তিক। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ নীচে তুলে ধরা হল।

Advertisment

শেষ বলের ছয়টা নিয়ে কি সন্দিহান ছিলেন?
আমি জানতাম যে, ব্যাটে-বলে সংযোগটা খুব ভাল হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার বড় মাঠে শটটা অনেকটা ফ্ল্যাট গিয়েছিল। যখনই শটটা নিয়েছিলাম তখনই বুঝেছিলাম যে, এটা অনেক দূরে যাবে। ব্যাটের সেন্টার থেকেই বলটা হিট করেছিলাম। শট নেওয়ার পরেও ব্যাটটা আমার হাতে ঘোরেনি। কিন্তু যেহেতু শটটা অনেকটা ফ্ল্যাট ছিল, কোথাও একটা সন্দিহান ছিলাম ছয় নিয়ে। দেখলাম দড়ির একটু খানি উপরে গিয়েই পড়ল বলটা।

বিজয় শঙ্কর যখন ১৭ নম্বর ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানের বলগুলোয় বিট খাচ্ছিলেন, তখন আপনার কেমন লাগছিল?

দেখুন সব  ক্রিকেটারই এরকম কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যান, এক একটা দিন আসে যখন ব্যাটে বলে ঠিকঠাক কানেক্ট হয় না। বিজয় কানেক্ট করারই চেষ্টা করছিল,কিন্তু হচ্ছিল না। যাঁরাই ক্রিকেটটা খেলেছেন তাঁরাই জানেন, এখানে স্নায়ুর কতটা ভূমিকা থাকে। এটা দুর্ভাগ্যের  যে, বিজয় প্রথমবার ভারতের হয়ে ব্যাট করতে নেমেই এরকম ফাইনাল ম্যাচের চাপে পড়ল। কিন্তু ওর জন্য এটা বিশাল শিক্ষণীয় হয়ে থাকল। ওর সঙ্গে এরপর আমার কথা হয়েছে। বিষয়টা ও ইতিবাচক ভাবেই নিয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতে আরও অনেক বড় কিছু অর্জন করবে ও।

সাংবাদিক সম্মেলনে রোহিত শর্মা বললেন যে, ব্যাটিং অর্ডারে নীচে নামার জন্য আপনি রাগ করেছেন!

না রাগটা ভুল শব্দ, আমি চমকেছিলাম। গোটা টুর্নামেন্টেই আমি ছ নম্বরে ব্যাট করেছি, হঠাৎ  দেখলাম বিজয় আমার আগে নামল। সেটা দেখেই চমকে গিয়েছিলাম। রোহিতের সঙ্গে আমার দারুণ বোঝাপড়া রয়েছে। ওর ক্যাপ্টেন্সিতে আমি আইপিএল জিতেছি। ওকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করি। আমি জানি ও আমাকে একজন ক্রিকেটার হিসেবে যথেষ্ট সমীহ করে। বিজয়ের আগে নামার ঘটনায় আমি কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম, আমি রোহিতকে বলেছিলাম,  তুমি বিজয়কে আমার আগে নামানোর ব্যাপারে নিশ্চিত তো? গোটা টুর্নামেন্টে তো ও ব্যাট করেনি। আমি জানতাম এই সিদ্ধান্তের পিছনে বড় কারণ রয়েছে।

publive-image I

ডাগআউটে থাকার সময় আপনার মাথার মধ্যে কী চলছিল?

আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না যে, ম্যাচে কী হতে চলেছে! এই পিচে ব্যাট করাটা মোটেই সহজ ছিল না। ওরা খুব ভাল লাইনেই বল রাখছিল। এমনকি, এর আগের লিগ ম্যাচগুলোতেও তাই করেছে বাংলাদেশ। রোহিতের মতো ব্যাটসম্যানদেরও ৫০ রান করতে ৪০-৪২ বল লেগছে। প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের জন্য ওদের আলাদা পরিকল্পনা ছিল, সেভাবেই সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছিল। রবিবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

কী ভাবনা মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নেমেছিলেন?

আমি শুধু প্রত্যেক বলে চার মারার কথাই ভাবছিলাম, এরকম পরিস্থিতিতে আর কিছু করার কথা মাথাতে থাকেও না। আমি ডাগআউটে আমাদের ফিল্ডিং কোচ আর শ্রীধরের পাশে বসেছিলাম। উনি বলছিলেন, আমাদের শুধু দুটো ওভারে বড় রান চাই। আর এই কথা হতে হতেই আমি নেমে পড়লাম ব্যাট হাতে। প্রতি বলে মারা ছাড়া আর কোনও রাস্তাই ছিল না আমার কাছে।

বিজয় শঙ্করকে মাঠে নেমে কী বলেছিলেন আপনি?

আমি বিজয়কে বলেছিলাম ছয়ের বদলে চার মারারই চেষ্টা করো, আমি ভেবেছিলাম ও যদি চার মারার চেষ্টা করে তাহলে ও খুব বেশি জোরে মারতে হবে না ওকে, ভাগ্যক্রমে ২০ নম্বর ওভারে ও গুরুত্বপূর্ণ চারটা পেয়েছিল।

আচ্ছা আপনি প্রথম বলেই কী করে ছয় মারলেন?

আগের ম্যাচে রুবেল হোসেন আমাকে ইয়র্কার দিয়েছিল, পাশাপাশি বলটা রিভার্সও করিয়েছিল। জানতাম ও আবার ইয়র্কার দেওয়ারই চেষ্টা করবে। আমি তাই বলটাকে নিচ থেকে খেলেই উপরে তুলতে চেয়েছিলাম। সেই জন্য ক্রিজ থেকে এগিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম। সাধারণত ক্রিজের ভিতরেই থাকি আমি, কিন্তু এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলাম। লং অনের উপর দিয়েই মারতে পারলাম।

publive-image

দ্বিতীয় বলেও চার মারলেন কীভাবে?

আমি ফাঁকের মধ্যে দিয়েই বলটা গলাতে চেয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে শটটা নিয়েছিলাম, আমি ভাগ্যবান, যেখানে পাঠাতে চেয়েছিলাম সেখানেই গিয়েছিল বলটা।

এরপর তিন নম্বর বলেও ছয়!

এবার আমি ক্রিজের ভিতরেই ছিলাম, জানতাম ও আর ইয়র্কার দেবে না, কারণ আমি ওকে মেরেছি। আমি বোলারের ভাবনা ভেবেই শটটা নিয়েছিলাম। দেখলাম ক্লিক করে গেল।

চার নম্বর বলে আপনি বিট খেলেন ও পাঁচ নম্বর বলে দু রান করে নিলেন!

আমি জানতাম ও সব বলেই গতির সঙ্গে বৈচিত্র্য রাখার চেষ্টা করবে। ও স্লোয়ার দিয়েছিল, কিন্তু ওই পিচে ব্যাট করা মোটেই সহজ ছিল না। আমি কাট করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্ত কানেক্ট করতে পারিনি। পঞ্চম বলটায় আমি এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে মারার চেষ্টা করেছিলাম, যদি ও স্লোয়ার দিত তাহলে বলের নিচ থেকেই তোলার চেষ্টা করতাম, কিন্ত যেটা চেয়েছিলাম সেটা পারিনি।

এরপর শেষ বলে আবার চার !

আমি আগেই বলেছিলাম যে, সব বলে চার মারার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু আমি বড় ছয় মারার চেষ্টাও করিনি। মাঠের ফাঁক খুঁজে নেওয়াটা এখানে  গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্রিজ পজিশনটা সব কথা বলে দেয়। আর আমার এই উন্নতির কৃতিত্ব শুধুমাত্র অভিষেক নায়ারেরই। হয়তো শেষ বলটায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ও আমাকে ফুল লেন্থে বা অফ-স্টাম্পে বল করার চেষ্টা করবে। এমন একটা পজিশনে চলে এসেছিলাম, যেখান থেকে স্কুপ করা যায়। আমার মনে হয় ভাবনার দিক থেকে ওর থেকে এক কদম এগিয়ে ছিলাম আমি।

আপনি অভিষেক নায়ারের কথা বারবার বলছেন, উনিই আপনার ক্রিজ পজিশন বেটার করেছেন ?

হ্যাঁ নায়ারাই আমাকে শিখিয়েছে ক্রিজ পজিশন, আমরা যখন প্র্যাকটিস করতাম তখন ও আমাকে বলত যে, ক্রিজের কতটা ভিতরে থাকা উচিৎ। ও নিজে এটা খুব ভাল জানে। এটার সঙ্গেই বলের গতিটা নির্ভরশীল। অতীতে এই বিষয়গুলোতে আমি পিছিয়ে ছিলাম অনেকটা। আমি অন্ধের মতোই স্টেপ আউট করতাম। এখন সবটা বুঝতে পারি।

শেষ ওভারে যখন ১২ রান বাকি ছিল তখন শঙ্করকে আপনি কী বললেন?

আমি জানতাম একটা বড় রান পেলেই ম্যাচ আমাদের দখলে চলে আসবে। আমি শঙ্করকে বলেছিলাম, চার মারার চেষ্টা করো। ব্যবধান যত কমবে বিপক্ষের উপর চাপ তত বাড়বে। আমরা একটা চার ও একটা সিঙ্গল পেয়েছিলাম। সৌম্য সরকার একদম ওর মনের মতো একটা ইয়র্কার দিয়েছিল আমাকে। এবারও আমি ক্রিজের পিছনে চলে গিয়েছিলাম।শঙ্কর যখন আউট হয় তখন ভেবেছিলাম যে, আমাকে সেরা শটটাই মারতে হবে।

ম্যাচের শেষ বলটা নিয়ে কী বলবেন, যখন এক বলে পাঁচ রান বাকিই ছিল।

শেষ বলে আমি ঠিকই করে নিয়েছিলাম যে, ছয় ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আশা করছিলাম সৌম্য যেন ইয়র্কার দিতে গিয়ে মিস করে। এরকম পরিস্থিতিতে বোলাররা ইয়র্কারেই সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখে। শেষ বলটা ও একটু ওয়াইড লেন্থেই রেখেছিল। আমি সর্বশক্তি দিয়েই মারি। ওটা দুরন্ত একটা মুহূর্ত ছিল। দলের সবাই এগিয়ে এসে এভাবে সেলিব্রেট করল। দুর্দান্ত লাগছে।

আপনার জায়গা অন্য যে কেউ থাকলে এরকম ম্যাচ জেতার পর সেলিব্রেশনে ভাসত, কিন্তু আমি অত্যন্ত শান্ত ছিলেন। এটা আপনার জাভেদ মিঁয়াদাদ মুহূর্ত ছিল। কী বলবেন?

আসলে আমি খুব একটা সেলিব্রেট করার মতো মানুষ নই। ভীষণ লাজুক প্রকৃতির একজন। নিজের রাগটাও কখনও খুব চেঁচিয়ে প্রকাশ করি না। যখন আমরা উইকেট নিই তখনও আমি খুব একটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি না। অনেকেই আমাকে এটা-ওটা প্রশ্ন করে, আচ্ছা আপনি কেন লাফান না? কেন আপনি সব ছুঁড়ে ফেলেন না? কেন নাগিন নাচ নাচলেন না? আসলে আমি মুহূর্তটা উপভোগ করি। হয়তো অন্য কোনও দিন আলাদা ভাবে সেলিব্রেট করব।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার কাছের বন্ধুরা লিখেছেন যে, শেষ ১৪ বছর ধরে এরকম একটা মুহূর্তের অপেক্ষাই করছিলেন আপনি, আপনি সবসময় ভারতকে এভাবে ম্যাচ জেতাতে চেয়েছিলেন।

আমার মনে হয়, যখন আমি খেলা শুরু করি তখন থেকেই এরকম একটা ম্যাচ জেতাতে চাইতাম দেশকে। আমাদের দলের ট্রেনার বসু শেষ ১৭-১৮ বছর যাবৎ আমার বন্ধু। উনি আমাকে বলতে থাকেন, কতবার তুমি চ্যাম্পিয়নের মতো ম্যাচ জিতিয়ে মাঠের মাঝখান থেকে দৌড়ে এসেছ?  এসব কথাগুলো বড্ড মনে পড়ছে। উনি আজ খুব খুশি। এতগুলো বছর আমাদের অনেক কথা হয়েছে। আজ আমার জন্য ওঁর আনন্দ হচ্ছে।

cricket
Advertisment