ডগলাস সিলভা
আমি ধ্বস্ত, বিধ্বস্ত। গতকাল রাতে শোনার পর থেকে আমি জানি না কী বলব, কেন বলব! যাঁর সঙ্গে কয়েকদিন আগেই কথা বলব, সেই কিনা নেই। স্রেফ অতীত হয়ে গেলেন। এমনিতে ডিনারের পরে শোবার আগে ফোন ঘটাঘাঁটি করার অভ্যেস আমার। সেখানেই একটা ফেসবুক গ্রুপে হঠাৎ নজর এল সুভাষ ভৌমিক নাকি প্রয়াত! একী অসম্ভব খবর, ভাবতেও পারছি না।
জানতাম শরীর খারাপ। অতিমারীতে ভারতে তৃতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে যে উনি ভর্তি সেই খবরও পেয়েছিলাম। ডায়ালিসিস চলছে সেই কথা জানিয়েছিল কলকাতার বন্ধুরা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম প্রতিদিন। জানতাম উনি লড়াকু ফাইটার বরাবরের মত। এই যুদ্ধে উনি জিতেই ফিরে আসবে।
ফেসবুক পোস্ট দেখার পরেই কয়েকজনকে মেসেজ করি খবরটা কনফার্ম করার জন্য। তারপরে গোটা রাত কেটে গিয়েছে। চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কত অজস্র স্মৃতি যে ভিড় করে আসছে!
আরও পড়ুন: ৭৫-এর মহাকাব্য থেকে খসল আবেগের পাতা! বন্ধুর বিদায়ে শোকস্তব্ধ সেই ম্যাচের সৈনিকরা
সুভাষ ভৌমিককে আমি বস বলতাম। ব্রাজিলিয়ান বিখ্যাত স্যান্তোসের প্রোডাক্ট। ব্রাজিল তো বটেই ভারতেও একাধিক ক্লাবে বহু কোচের সান্নিধ্যে খেলেছি। তবে বলতে দ্বিধা নেই, ফুটবল প্রজ্ঞায়, জ্ঞানে উনি অদ্বিতীয়। ফুটবল শিক্ষা তো বটেই ওঁর ম্যান ম্যানেজমেন্ট স্কিল ছিল বিশ্বপর্যায়ের। ফুটবলারদের চাহিদা, অভাব-অভিযোগ পূরণে সিদ্ধহস্ত তিনি। উনি আমাকে ক্লাবে বিদেশি হিসাবে আলাদা ব্যবহারই করতেন না। ওঁর কাছে সকলেই ছিলাম সমান। এতে দলের একাত্মতা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
ইস্টবেঙ্গলে খেলার পরে মোহনবাগান, ভবানীপুর, মহামেডানের মত ক্লাবে খেলেছি। তবে এখন স্বীকার করছি, স্রেফ পেশাদারিত্বের তাগিদে নয়, ভারতে একের পর এক মরশুম কাটিয়েছি বসের সান্নিধ্যে কাটাব বলে। এতটাই উনি আপন করে নিয়েছিলেন আমাকে।
আরও পড়ুন- সুভাষ ভৌমিকের চিকিৎসা হবে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে, পাশে দাঁড়ালেন ক্রীড়ামন্ত্রী
শিক্ষিত ছিলেন। শিক্ষার সেই আলো মিশিয়ে দিয়েছিলেন নিজের ফুটবল কোচিংয়ে। হয়ে উঠেছিলেন ফুটবল কোচিংয়ের একমেবাদ্বিতীয়ম। শুধু ফুটবল নয়, ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছুই ওঁর কাছ থেকে শেখা আমার।
আশিয়ানের সেই ঐতিহাসিক জয়ের কথা না বললে সবকিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেই জয়ের পরে উনি আসলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এত বড় সাফল্য ফুটবলারদের মাথা ঘুরিয়ে দেবে। তবে আমি যতদিন ওঁর প্রশিক্ষণে খেলেছি সবসময় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি।
আমি ডার্বিতে অপরাজেয়। এর অনেকটাই কৃতিত্ব উনি দাবি করতে পারেন। প্রত্যেক ডার্বির আগে উনি সকল ফুটবলারদের বলতেন, অনুশীলনের কোনও বিকল্প নেই। ডার্বির আগে কয়েক সপ্তাহ উনি প্রাণান্তকর অনুশীলন করাতেন। কঠোর ট্রেনিংয়ের কোনও বিকল্পই ছিল না ওঁর কাছে। আমি সবসময় বলতাম, "বস আমি তো মাঠে থাকছি, কোনও চিন্তা নেই।"
ফুটবল কেরিয়ারে ইতি টানার পরে ভারত, বাংলাদেশ, ব্রাজিলের একাধিক ক্লাবে কোচিংয়ের ভাগ্য যাচাই করেছি। স্বীকার করছি, আমার কোচিংয়ে ওঁর প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে।
আরও পড়ুন: না ফেরার দেশে সুভাষ! ময়দানি ফুটবলের এক যুগের অবসান
ইস্টবেঙ্গলের কোচিংয়ের প্ৰথম দিন এখনও মনে রয়েছে। উনি সাক্ষাতের সময়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিছু খেতে চাই কিনা! কয়েক মাস আগে আইলিগের দল ট্রাউয়ের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলাম। সেই সময় আমার ভারতে আসার খবর পেয়ে বস মেসেজ করে আমাকে ওঁর নিউ আলিপুরের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কী খেতে চাই, আগাম তা জানাতে বলেছিলেন। অতিমারী শেষ হলেই ভেবেছিলাম যাব কলকাতায়। প্রিয় বসের সঙ্গে দেখা করতে। সেই আমন্ত্রণ যে এভাবে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, ভাবতেও পারছি না।
বস, তুমি আজীবন আমার হৃদয়ে থাকবে!
Read the full article in ENGLISH
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন