সুদীপ্তা সেনগুপ্ত, আটের দশকের বঙ্গজীবনের আলোচনায় উঠে আসত তাঁর নাম। প্রথম বাঙালি এবং যুগ্মভাবে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে অ্যান্টার্কটিক বা দক্ষিণ মেরু অভিযানে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে ইতিহাস লেখা বাংলার এই দুঃসাহসিক নারী এবারে 'আমার দুর্গা' বিভাগের জন্য় মনোনীত।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্রাকচারাল জিওলজির অধ্যাপিকা হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব সামলানো সুদীপ্তা এখন নিয়মিত ক্লাস করান না। গবেষণার কাজেই সপ্তাহে এক-দু’দিন আসেন। তাঁর দেখানো পথেই আজও অনেকে বিশ্বের সবচেয়ে শীতল ও শুষ্ক মহাদেশে পা রাখার স্বপ্ন দেখেন।
আটের দশকে আপনার দেখানো পথ ধরে আজ মেয়েরা কতটা এগিয়েছে?
আমি অ্যান্টার্কটিক থেকে ফিরে আসার পর অনেক মহিলাই গিয়েছেন ওখানে। আমার ছাত্রী নীলাঞ্জনা সরকারই যাচ্ছে। আমার বই পড়েই ও জিওলজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে। নীলাঞ্জনা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন। এখন ত্রিবান্দ্রমের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ওর স্বপ্ন ছিল অ্যান্টার্কটিক যাওয়ার। সেই স্বপ্নের পথেই হাঁটছে নীলাঞ্জনা।
আপনার জন্য়ই কি জিওলজিকে বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে?
অবশ্য়ই, আমি দরজাটা খুলে দিয়েছি বলতে পারেন। আমি যাওয়ার পর থেকেই সার্বিকভাবে মেয়েদের মধ্যে জিওলজি পড়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। যাদবপুরের অনেক ছাত্রীই আমাকে এসে বলেছে যে, তাদের আমার বই পড়ে বা কথা শুনেই জিওলজি পড়ার ইচ্ছা হয়েছে।
অ্যান্টার্কটিক অভিযানে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রতিকূল অভিজ্ঞতা কী ছিল?
দেখুন, যেহেতু আমি জিওলজিস্ট, আমি পঞ্চাশ বছর আগে জিওলজি পড়েছি। চল্লিশ বছর আগে সেই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। তখন এটা পুরোপুরি পুরুষকেন্দ্রিক পেশা ছিল। কোনও একটা জায়গা নেই যেখানে আমাকে লড়তে হয়নি। প্রতিটা পদক্ষেপে আমি লড়াই করেছি। আমার সময় কোনও মেয়েই ছিল না সে অর্থে। এখন সেখানে চল্লিশ শতাংশ মেয়ে। ক্লাসেও দেখি ফিফটি পার্সেন্ট মেয়ে। সব জায়গাতেই এখন মেয়েদের সংখ্য়া বেড়েছে। শুধু ভারতেই নয়, বিদেশেও কিন্তু পরিস্থিতি এমনটাই ছিল। এখন চিত্রটাই বদলে গিয়েছে। অনেক মেয়ে এসেছে পেশায়।
জিওলজিক্য়াল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ছেড়ে যাদবপুরে এলেন কেন?
জিওলজিক্য়াল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে আমাকে সবচেয়ে বেশি লড়াই করতে হয়েছে। জানেন, আমাকে ফিল্ডেই যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। তখন খুব মুশকিল হয়েছিল। এত বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছিলাম যে মনসংযোগই করতে পারছিলাম না। কাজকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল সেই বিরোধ। বাধ্য় হয়ে আমি যাদবপুরে চলে আসি।
আপনাকে কি পুরুষদের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়েছিল?
পুরুষদের যেখানে প্রাধান্য, সেখানে একজন মহিলা এলেই তৈরি হয় সমস্য়া। তাঁকে কিছু করতেই দেওয়া হয় না। মানসিকতার কোথাও একটা সমস্য়া রয়ে যায়। পুরুষদের মধ্য়ে একটা দমিয়ে রাখার প্রবণতা কাজ করে। কোনও মহিলা যদি কাজের ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর আরও সমস্যা হয়। কিছু করতেই দেওয়া হয় না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় এটাই দেখেছি। ওঁরা এই প্রতিযোগিতা মেনে নিতে পারেন না।
যাঁরা সুদীপ্তা সেনগুপ্ত হতে চাইবেন, তাঁদের জন্য় কী পরামর্শ থাকবে আপনার?
স্বপ্ন পূরণটা আসলে মানসিক প্রস্তুতি। সফল হতে গেলে লড়াই করতেই হবে। জীবনটাও কিন্তু অ্যান্টার্কটিক অভিযানের মতোই। এটা কিন্তু হোটেলে থেকে আরাম করার জায়গা নয়। মানসিক ভাবে কেউ যদি মনে করেন তাঁকে পারতেই হবে, তাহলে তিনি পারবেনই।
আপনাকে কারা সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন?
একজনের কথা বলব না। অনেকেই ছিলেন। ছোটবেলায় বাবার মুখে বিজ্ঞানী মারি কুরির কথা শুনেছি। যিনি প্রথম মহিলা হিসাবে নোবেল পুরস্কার জেতেন। সেসব শুনে আমি ভাবতাম, আমিও এরকমই হব। আবার যখন স্কট বা অ্যামান্ডসেনের কথা শুনেছি, তখন ভাবতাম আমিও ওরকম অভিযানে যাব।
আপনার কাছে দুর্গার সংজ্ঞা কী?
যে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়, সেই আমার কাছে দুর্গা। বাড়ির কাজের মেয়েটির মধ্য়েও দুর্গাকে পাই। তারা যেভাবে প্রতিকূলতার মধ্য়ে দিয়ে এগিয়ে যায়, সেটার তারিফ করতেই হয়। যেভাবে লড়াই করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করছে, সংসার চালাচ্ছে! ভাবলেই চোখে জল চলে আসে। সেখানে আমার লড়াই কিছুই না। এত অল্পবয়সী মেয়েরা কী সুন্দর হাসিমুখে লড়াই করে যাচ্ছে। তারিফ করার কোনও ভাষাই নেই আমার। আজকাল ঘরে ঘরেই দুর্গা। যে কোনও পেশার মেয়েরাই ঘর-বাইরে দু'টোই এক হাতে সামলাচ্ছেন।
আপন কি নিজের মায়ের মধ্য়েও দুর্গাকে খুঁজে পান?
অবশ্য়ই. আমার মা আমার দুর্গা। আমার মা না থাকলে কোনও দিকে এগিয়ে যেতে পারতাম না। আমরা তিন বোন। আমাদের তৈরি করেছেন মা। কোনও বিভেদ না-রেখেই মা আমাদের তৈরি করেছেন। অনেকেই তখন বলেছেন, মেয়েদের এত স্বাধীনতা দিও না। কিন্তু উনি কানেই তোলেন নি সেইসব কথাবার্তা। কিছু মানেন নি। সমানভাবে স্বাধীনতা দিয়েছেন। বিশ্বাস করেছেন।