শিবপুরের সরু গলিটা আজও নির্জন। বিশেষ হাঁকডাক থাকে না। থাকবেই বা কেন, সামনে প্রশস্ত রাজপথের গ্ল্যামারের সঙ্গে কিঞ্চিৎ বেমানান বটে আনন্দ কুমার চৌধুরী লেন! ভারতীয় ফুটবলের ট্র্যাজেডির সূত্রপাত যে এই লেন থেকেই। নব্বইয়ের দশকে শিবপুরের এই সরু, অনামি লেনেরই বাসিন্দা ছিলেন ময়দানের অন্যতম দাপুটে ফুটবলার সঞ্জীব দত্ত। এখন অবশ্য ফুটবলার হিসাবে নয়, ভারতীয় ফুটবলের মোহনায় বিষাদ সাগর হয়েই রয়ে গিয়েছেন।
ভারতে ফুটবলার হিসাবে খেলতে খেলতে তিনিই প্রথম মারা যান। ফুটবলার হিসাবে কীর্তিতে নয়, মৃত্যুর কাহিনীতে শীর্ষে থেকেই সেই সংকীর্ণ লেনের বাসিন্দাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন শিবপুরের রাজা। দিনটা ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভালোবাসার দিনেই অকালে ঝরে পড়েছিল বিস্ময় প্রতিভা। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে রেখে চলে গিয়েছিলেন অনেক দূরে।
ডাকনাম রাজা। রাজার মতই খেলতেন। তবে সেই খেলার মাঠে জীবন যুদ্ধে আর জিতে আসা হল না! রেলওয়েজের জার্সিতে ১৯৯৫-এ অংশ নিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের বিপক্ষে। টানটান ম্যাচে বল দখলের লড়াইয়ে অন্ধ্রের এক ডিফেন্ডারের কনুই আছড়ে পড়ে রাজার বুকে। সঙ্গেসঙ্গেই অচৈতন্য হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও আর সম্বিৎ ফেরেনি। পাড়ি দেন চির ঘুমের দেশে।
আরো পড়ুন: ডগলাস না থাকলে বাঁচতাম না! এরিকসেনকে দেখে পুরোনো ক্ষত ফের দগদগে মৃত্যুঞ্জয়ী দেবজিতের
শনিবার রাতে এরিকসেন মাঠে লুটিয়ে পড়তেই রাজার স্মৃতি যেন কালবৈশাখি হয়ে নেমে আসে চেতলায়। মোহনবাগানের আইলিগ জয়ী কোচ ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড খেলার সময় এরিকসেনের শুয়ে পড়া দেখেই আঁতকে ওঠেন। সঙ্গসঙ্গেই টিভি অফ করে দেন। এরিকসেনকে দেখে তাঁর যে মনে পড়ে যাচ্ছিল রাজা-কে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে সঞ্জয় সেন শিউরে ওঠা গলায় বলে চলেন, "এরিকসেনের সেই ঘটনার পরেই সটান টিভি বন্ধ করে দিই। বারবার রাজার মুখ যেন ভেসে আসছিল। এই জিনিস ভোলা যায় না!" ফুটবল কেরিয়ারে মহা-ট্র্যাজেডির সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন অজান্তেই। দুঃসহ স্মৃতি নেড়েচেড়ে সবুজ মেরুনের প্রাক্তন কোচ বলছিলেন, "সেই সময় মাঠে এম্বুলেন্স, সিপিআর তো দূর অস্ত, টিমে কোনো ডাক্তারই থাকতেন না। এখনকার মত। টিম বাসে করে হাসপাতালে ছোটা হয়েছিল। সারা রাস্তা স্যালাইন ধরে বসেছিলাম আমি। ও আমার কোলেই মাথা রেখেছিল।"
আরো পড়ুন: মোহনবাগান ম্যানেজমেন্ট এই মুহূর্তে অনেক ভাল! লাল-হলুদ কর্তাদের একহাত নিয়ে বিস্ফোরণ রাইডারের
সেই বিভীষিকা, সেই আতঙ্ক বারবার এত বছর পরেও তাড়া করে কোচ সঞ্জয়কে। একদম হৃদয়ের বন্ধু ছিলেন। রেলওয়েজের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলতে যাওয়ার কিছুদিন আগেই দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন সঞ্জীব দত্ত এবং সঞ্জয় সেন। পুজো দেওয়ার পরেই হাত থেকে প্রসাদীর মিষ্টি পড়ে যায়। পড়ে যাওয়া সেই মিষ্টি আবার নিয়ে যায় এক কালো কুকুর!
তবে এসব নিছকই কাকতলীয় মনে করেন সঞ্জয় সেন। এতদিন পর সেই ইঙ্গিতবাহী ঘটনার কথা উঠলে তিনি বলে দেন, "সিঁড়ি দিয়ে গঙ্গায় নামার সময় হাত থেকে প্রসাদ পড়ে গিয়েছিল। তবে সেসব নিশ্চয় কাকতালীয় ঘটনা। ওঁর মৃত্যুর পরে এসব সঙ্কেত নিয়ে মনে হয়েছিল বটে, তবে সেসব এখন আর মনে হয়না। হাত থেকে তো কত কিছুই পড়ে যায়!"
কত বছর কেটে গিয়েছে। তবু আজও সেই কালো রাত ঘুরে ফিরে আসে সঞ্জয় সেনের স্মৃতিতে। মাঠে মৃত্যুর খবর শুনলেই তিনি দুঃস্বপ্নের সরণি ধরে চলতে শুরু করেন অতীতে। তিনি এখন অবশ্য ভারতীয় ফুটবলের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিকাঠামো নিয়ে সন্তুষ্ট তিনি। বলছিলেন, "ইউরোপের মত না হলেও আইএসএলের দৌলতে এখন প্রত্যেক টিমেই একাধিক চিকিৎসক থাকেন। জরুরিকালীন মুহূর্তের জন্য আগাম প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি আমরা।"
এই সন্তুষ্টির মাঝেই আবার আক্ষেপও লুকিয়ে থাকে তাঁর গলায়, "এখনকার মত হলে রাজাকে চলে যেতে হত না অকালে!" আসলে ভারতীয় ফুটবলের প্রথম শহিদ, ট্র্যাজেডির মহানায়ক যে সঞ্জীব দত্ত, সকলের প্রিয় রাজাদা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন