ইউটিউব ঘটাঘাঁটি করলে এখনও সেই সব গোলের ভিডিও স্ক্রিন জুড়ে ফুটে ওঠে। ভ্যান বাস্তেন, রবার্তো কার্লোস থেকে মাইকন হয়ে হালের সমীর নাসরি, করিম বেনজেমাদের দেখা যায় দুরূহ সমস্ত কোন থেকে অবলীলায় বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে গোল করে চলেছেন। লক্ষ্মীবারে দেশের ফুটবল মহলে যেন সেই ভিডিওগুলোই আরও আক্ষেপ হয়ে ধরা দিল। লাইভ ক্যামেরা থাকলে যে মাইকনদের সঙ্গে দেখা যাওয়ার কথা ছিল সুরজিৎ সেনগুপ্ত নামক জনৈক বঙ্গ ফুটবলারেরও।
বাঙালির নস্ট্যালজিয়ার কর্পূরে চোবানো সত্তরের দশক যখন এক মাসের মধ্যে দু-দুবার অনাথ হয়ে পড়ল, সেই সময় যেন সমস্ত আক্ষেপ জড়ো হয় সাব্বির আলির গলায়। সুভাষ ভৌমিককে হারিয়েছে ময়দানি ফুটবল। সেই বিয়োগের রেশ কাটার আগেই সত্যিকারের এবার প্রাক্তন হয়ে গেলেন যে সুরজিৎ সেনগুপ্ত!
আরও পড়ুন: কৃশানুর সেই ছেঁড়া কার্টিলেজ এখনও রেখেছেন সঙ্গে, প্রেমদিবসে নস্ট্যালজিক স্ত্রী পনি
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা ফোন পেয়ে কার্যত স্বর-হারানো গলায় সাব্বির আলি বলে ফেললেন বন্ধুর সেই কীর্তির কথা। ১৯৭৯-এ শিল্ড খেলতে এসেছিল উত্তর কোরিয়ার জাতীয় দল। শিল্ডে যেহেতু জাতীয় দলের অংশ নেওয়ার প্রথা ছিল না, তাই উত্তর কোরিয়ার জাতীয় দল-ই শিল্ড খেলতে নেমে পড়ে পিয়ং ইয়ং একাদশ নামে। ফাইনালেই সেবার শক্তিশালী পিয়ংইয়ংয়ের সামনে পড়ে যায় ইস্টবেঙ্গল।
আর সেই শিল্ড ফাইনাল-ই সুরজিৎ সেনগুপ্তের রঙিন কেরিয়ারের অন্যতম মুকুট এনে হাজির করে দিয়েছিল। ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল নাস্তানাবুদ করে জিতেছিল কোরিয়ান দলটির বিরুদ্ধে। তবে রূপকথার মুহূর্ত হাজির করে যান সুরজিৎ। কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে ডেড অ্যাঙ্গেল থেকে সরাসরি গোল করে যান তিনি। হতবাক হয়ে যায় কোরিয়ান দলটি।
বৃহস্পতিবার অজস্র স্মৃতি যেমন উথাল পাতাল করা স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছে সাব্বির আলিকে, তেমন আক্ষেপের মাহেন্দ্রক্ষণ ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁকে। ফেলে আসা সেই ম্যাচের স্মৃতি এখনও টাটকা সাব্বিরের কাছে। "সুরজিৎ মাঠে ডানদিকে উঠেই আমাকে ক্রস বাড়াত। এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ওই ন্যারো গোলের সময়েও আমি ওঁর ক্রসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তবে ও যে সরাসরি গোল করে দেবে ওখান থেকে ভাবতে পারিনি। এখনকার মত তখন তো টিভি, ক্যামেরা ছিল না। থাকলে অন্য ব্যাপার হত!"
আরও পড়ুন: সুভাষকে কেন নয় দ্রোণাচার্য! প্রশ্ন ব্রাত্য মহাগুরু কোলাসোর, মুখ খুললেন নঈমও
বন্ধুর বিদায়ে যেন হতাশা চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে সাব্বিরের গলা থেকে। কিন্তু কীভাবে শিখলেন দুরূহ ওই কোন থেকে বিশ্বমানের ওই গোল। আসলে কলকাতার তিন প্রধানে খেলার আগে খিদিরপুরে খেলতেন সুরজিৎ। সেখানেই প্রশিক্ষক অচ্চুৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ডেড অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করানো অনুশীলন করাতেন। ক্রমাগত মাজাঘষা করে পিয়ংইয়ং ম্যাচে আসে সেই স্বপ্নের গোল।
সাব্বির আলির সঙ্গে সুরজিৎ সেনগুপ্ত (ছবি: সাব্বির আলি)
সাব্বির এক নাগারে বলেই।চলেছিলেন, "ওঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। দুজনে রাজ্য তো বটেই ক্লাবের হয়েও বহুদিন খেলেছি। '৭২, '৭৪ একসঙ্গে খেলেছি। সেই সময়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। সবসময় ও-ই আমাকে পাস বাড়াত। তবে একবার লিগে কালীঘাট ম্যাচে আমি তিনজনকে ড্রিবল করে ওঁকে বল বাড়াই। সেখান থেকে ও গোল করে।"
জমে থাকা বহু স্মৃতি অনর্গল বেরিয়ে আসতে থাকে, "৭৯-তে বাহরিনের বিরুদ্ধে খেলতে হয়েছিল ভারতকে। প্ৰথম ম্যাচে আমরা ০-৩ গোলে হেরে যাই। একদিনের বিশ্রাম নিয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে নেমে পড়তে হয়। আর সেই ম্যাচে সুরজিতের ক্রস থেকে জোড়া গোল করি হেডে। ম্যাচের পরে সুরজিৎ জিজ্ঞাসা করে বসে, 'আরে ক্যায়সে উতনা জাম্প কিয়া রে?' আমি বলে দিলাম, 'মালুম নাহি'।"
বন্ধুর তর্পণে উঠে আসে মাঠের বাইরে স্মৃতিও, "অ্যালবার্ট হলে একবার দিলীপ কুমার এসে উর্দুতে স্পিচ দিয়েছিলেন। আমরা শুনতে গিয়েছিলাম। পরে ওঁকে জিজ্ঞাসা করি, কিছু বুঝলি। ও মাথা নেড়ে না জানায়। আমি তখন উর্দুতে দেওয়া গোটা স্পিচ বুঝিয়ে বলি। দিলীপ-সাব বলেছিলেন, লতার কন্ঠ একদম শিশুর মত, দেশ-কালের সীমারেখার অনেক ঊর্ধ্বে। যেমন পাহাড়ি ঝর্ণা বা সূর্যের আলো কোনও দেশ, মজহব, গাঁওয়ের সীমানা মানে না। লতা মঙ্গেশকরের ভয়েস এরকমই কুদরত কি এক কারিশমা!"
ফুটবল থেকে অবসরের পরে দেশের ফুটবল দেখেছে কোচ সাব্বিরকে। আবার নিজের বাঁকানো ফ্রিকিকের মত সকলকে অবাক করে দিয়ে বুটজোড়া তুলে রেখে সাংবাদিক হয়ে গিয়েছিলেন সুরজিৎ। বৃহস্পতিবারের পরে কাকে আর উর্দু শায়েরি বাংলায় অনুবাদ করে শোনাবেন সাব্বির?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন