শেষবার সেই দেড় দশক আগে। রঞ্জির ফাইনালে সেই শেষবার। বিজয় হাজারে (২০০৬/০৭) বা সৈয়দ মুস্তাক আলিতেও (২০১৬/১৭) অবস্থা তথৈবচ। একবার করে সীমিত ওভারের দুই ফরম্যাটে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হলেও বাংলা দল ভারতীয় ক্রিকেটের মুলস্রোত থেকে ক্রমশ 'দূর হতে দূরে'।
এবারে আকাশদীপ, অভিমন্যু ঈশ্বরণ, ঈশান পোড়েলদের বাংলা রঞ্জির লিগ পর্ব দারুণভাবে শেষ করেছে। নকআউট পর্বে এখন থেকেই আশা জাগাচ্ছে মনোজ তিওয়ারির দল। তবে শেষমেশ আশাহত হতে হবে না তো! সেই আশঙ্কাই বাংলার ক্রিকেটমহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরও পড়ুন: বর্ধমানের স্পিডস্টার এবার বাংলার জার্সিতে! দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখছেন সুমন
অথচ এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না! যে রাজ্য থেকে উঠে এসেছেন জগমোহন ডালমিয়া বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত ক্রিকেট প্রশাসক, সেই রাজ্য জাতীয় স্তরে এরকম ব্রাত্য কেন? সিএবির জীবনকৃতি সম্মান পাওয়া পলাশ নন্দী তুলে আনছেন, ক্রিকেট খেলার পরিকাঠামোর অবস্থাকে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে মোহনবাগানে টানা আট বছর কোচিং করানো পলাশবাবু বলছিলেন, "বাংলার ক্রিকেটে পরিকাঠামোর অভাব তো রয়েইছে। তাছাড়া ক্রিকেটকে সম্প্রসারণও করা যায়নি। স্থানীয় স্তরেই ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।"
২০২০ সালের মোহনবাগান রত্ন পলাশবাবুর যুক্তি, বাংলার ক্রিকেটকে সর্বভারতীয় স্তরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। "তামিলনাড়ু, গুজরাটের মত প্ৰথমসারির ক্রিকেট খেলিয়ে রাজ্যের দিকে দেখা হোক। ওঁরা সারা বছর টি২০ ধাঁচের টুর্নামেন্ট আয়োজন করছে। আমাদের এখানে নাম কা ওয়াস্তে জেসি মুখার্জী টুর্নামেন্ট হচ্ছে। ব্যাস! স্রেফ নিজেদের মধ্যে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, কালীঘাট- এসব খেলে লাভ কী হচ্ছে?"
আরও পড়ুন: মোহনবাগানের জার্সিতে ব্যাটে ঝড় তোলেন কোহলি! বিরাটের বাঙালি কোচ এখনও সুখ-স্মৃতিতে ডুবে
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবসরের পরে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন মাত্র চারজন- গত দশকের শুরুতে অল্প সময়ের জন্য খেলেছেন মনোজ তিওয়ারি এবং অশোক দিন্দা। ঋদ্ধিমান সাহা স্কোয়াডে থাকলেও নিয়মিত কোনও সময়েই ছিলেন না। একমাত্র মহম্মদ শামি প্ৰথম একাদশের অটোমেটিক বাছাই এখনও পর্যন্ত।
বর্তমানে বাংলার অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরণ জাতীয় নির্বাচকদের নজরে ছিলেন। তবে গত মরশুমে ব্যাট হাতে ব্যর্থতা তাঁকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে রুতুরাজ গায়কোয়াড, পৃথ্বী শ-দের এলিট লিস্ট থেকে। তবে শামি হোক বা ঈশ্বরণ- কেউই বাংলার ভূমিপুত্র নন। শামি উত্তরপ্রদেশ, অভিমন্যু ঈশ্বরণ দেরদুন থেকে বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছেন। সর্বভারতীয় স্তরে নিজেদের জাত চেনানোর জন্য বাংলা ক্রিকেটকে প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করছেন ঈশ্বরণের মত তারকারা। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
অভিমন্যু ঈশ্বরণ দেরদুন থেকে ঘাঁটি গেড়েছেন বাংলায় (ক্রিকেটারের ফেসবুক)
এই বিষয়েই আপত্তি রয়েছে বাংলার একমাত্র রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলছেন, "বাংলা দলে অধিকাংশই ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার। ড্রেসিংরুমেও হিন্দিতে কথাবার্তা চালানো হয়। বর্তমানে স্কোয়াডের সাতজনই বাইরের, হয় ইউপি অথবা অন্য রাজ্যের। অন্য কোনও রাজ্যে তো এরকম হচ্ছে না! বাইরের ক্রিকেটার ঢোকানো বন্ধ না হলে স্থানীয় ক্রিকেটার ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবেই।"
কোথায় সমস্যা? বাংলার ক্রিকেট মহলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাংলার ক্রিকেটে বাইরের প্রদেশের ক্রিকেটারদের খেলা কোনও নতুন ঘটনা নয়। যুব পর্যায়ে অম্বর রায় সহ একাধিক টুর্নামেন্টে ভিন রাজ্যের ক্রিকেটারদের রমরমা। বাইরের রাজ্য থেকে এসে বাঙালিদের টেক্কা দিয়ে দেশের ক্রিকেটে পরিচিত হয়ে ওঠার ট্র্যাডিশন এখনও নাকি চলছে। অভিযোগ এমনই।
আরও পড়ুন: জিমন্যাস্টিক ছেড়ে দিয়েছেন রিও মাতানো দীপা! সাসপেন্ড হতেই বিরাট ঘোষণা কোচ নন্দীর
বাংলার ক্রিকেট নখদর্পনে থাকা এক ব্যক্তি বলছিলেন, "বাইরের রাজ্যের নামি ক্রিকেটাররা এখানে এসে খেললে সমস্যা নেই। তবে জুনিয়র পর্যায় থেকেই যেভাবে অন্যান্য রাজ্যের যুব ক্রিকেটাররা ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেটা চিন্তার। শারীরিক গঠনগত কারণে বাঙালিরা ওদের থেকে বেশ পিছিয়ে থাকে। এটাই যুব পর্যায়ে তফাৎ গড়ে দিচ্ছে। পরবর্তীতে বাংলার সম্ভবনাময় ক্রিকেটাররাও তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।" সিএবি-কে আরও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন হতাশ সেই ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব।
তবে সিএবি-র কোষাধ্যক্ষ দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, বঙ্গ ক্রিকেট সংস্থা এই বিষয়ে বেশ কড়া। তাঁর বক্তব্য, "এই মুহূর্তে বাইরের ক্রিকেটার তেমন কেউ নেই। আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের মত পরিচয় পত্র যাচাই করে দেখে নেওয়া হচ্ছে কলকাতা কিংবা এই রাজ্যের বাসিন্দা কিনা। তাঁরাই একমাত্র খেলতে পারবে। বাইরের ক্রিকেটারদের কোনওভাবেই এখন অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ফার্স্ট ডিভিশনে একমাত্র চারজন করে বাইরের ক্রিকেটার খেলানো যায়। সেকেন্ড ডিভিশন তো বটেই যুব পর্যায়েও ভিন রাজ্যের ক্রিকেটার খেলানো নিয়ম বিরুদ্ধ।"
ঋদ্ধিমান সাহা (টুইটার)
সিএবি যুগ্ম-সচিব হিসাবে রাজ্যের ক্রিকেটকে ফাস্ট ফরোয়ার্ড মোশনে ফেলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে চালু করেছিলেন 'ভিশন ২০২০'। সেই সময়ে সিএবির সভাপতি ছিলেন প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া। দেশের বিখ্যাত ক্রিকেট মস্তিষ্কদের নিয়ে এসে বাংলার ক্রিকেটারদের ক্লাস করানোর ক্যাম্প চালু করেন মহারাজ, ২০১৪-এ।
সেই উদ্যোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাংলা ক্রিকেটকে হাতের তালুর মত চেনা আব্দুল মুনায়েম। তিনি অবশ্য স্কুল ক্রিকেটে জোর দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। বলছিলেন, "প্রতিভা বা স্কিলের দিক থেকে বাংলার ক্রিকেটারদের সমস্যা নেই। তবে পাওয়ার হিটিংয়ে আমরা এখনও বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে। বাংলার ক্রিকেটারদের নিজস্ব ঘরানা রয়েছে। টেকনিক্যালি ভীষণ নিখুঁত আমরা।"
ছাত্রদের সঙ্গে কোচ আব্দুল মুনায়েম (ফেসবুক)
তাঁর আরও সংযোজন, "তবে সমস্যা অন্যত্র। মুম্বই, কর্ণাটক সমস্ত জায়গায় স্কুল ক্রিকেট থেকে জুনিয়র ক্রিকেটাররা উঠে আসে। আমাদের এখানে স্কুল ক্রিকেটে আরও নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে পাওয়ার হিটিংয়ের সমস্যা মেটানোর জন্য বড় মাঠে খেলার আয়োজন করতে হবে।"
পলাশ নন্দী এই পিছিয়ে পড়ার ময়নাতদন্ত করতে গিয়েই বলছিলেন, "বাংলার ক্রিকেটারদের আরও সর্বভারতীয় স্তরে ম্যাচ খেলা উচিত। হার্দিক পান্ডিয়া, ভুবনেশ্বর কুমার, পৃথ্বী শ-রা প্রতিপক্ষ হলে খেলার মান বাড়তে বাধ্য।"
এই প্রসঙ্গেই তিনি বাংলাকে দৃষ্টান্ত করতে বলছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। বলছিলেন, "বাংলাদেশের ক্রিকেট পরিকাঠামো সাম্প্রতিককালে দারুণ উন্নতি ঘটেছে। ওঁরাও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্ৰথমে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছিল। তবে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক স্তরে ম্যাচ খেলে ওঁদের ক্রিকেট বিশাল উন্নতি ঘটেছে। ওঁরা বুঝতে শিখেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হলে ১৪০-১৪৫ কিমির বল ফেস করতে হবে। ধীরে ধীরে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে খেলে খেলে ওঁরা আজকে এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।"
আরও পড়ুন: পোল্যান্ড বর্ডার পেরোতে পারব কিনা জানি না! আতঙ্কের ভিডিওয় EXCLUSIVE ইউক্রেন ফিজিও
আইপিএলের নিলাম হয়ে গেল কিছুদিন আগেই। ১০ ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ২০০-২৩০ জনের স্কোয়াডে শামি-ঋদ্ধিমান বাদে বাংলার ক্রিকেট প্রতিনিধি বলতে সাকুল্যে চারজন- ঈশান পোড়েল (পাঞ্জাব কিংস), শাহবাজ আহমেদ (আরসিবি), আকাশদীপ (আরসিবি), এবং ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায় (পাঞ্জাব কিংস)। ঘটনাচক্রে, মহম্মদ শামি (গুজরাট টাইটান্স) বাদে প্রত্যেকেই প্ৰথম এগারোয় যে অনিয়মিত, তা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়।
বাংলার হয়ে খেললেও ভূমিপুত্র নন শামি (টুইটার)
নাইট রাইডার্সও বাঙালি ক্রিকেটারদের তুলে আনার ক্ষেত্রে সেরকম সদর্থক ভূমিকা নিচ্ছে না, বলে অভিযোগ উঠছে। বাংলার ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি বলছিলেন, "পাঞ্জাব কিংস অর্শদীপ সিংকে নিলামের আগেই রিটেন করেছিল। মুম্বইও অর্জুন তেন্ডুলকরকে নিয়েছে। প্রত্যেক ফ্র্যাঞ্চাইজিই স্থানীয় ক্রিকেটারদের তুলে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। তবে কেকেআরের সেই উদ্যোগ কোথায়!"
সবমিলিয়ে দেশের ক্রিকেট মানচিত্রে ফের কবে একজন বঙ্গ ক্রিকেটারের শাসন দেখা যাবে, তা নিয়ে হা হতাশ কিন্তু বাড়ছেই।