কয়েক বছর আগে টিভিতে বাবা রামদেবের পেট কাঁপানো থেকে চোখ-সহ শরীরের নানা অঙ্গের ব্যায়াম দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন অনেকেই। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে দিনরাত বৌদ্ধিক পরিশ্রমে ব্যস্ত জনতার অনেকেই স্বগতোক্তি করে বসেছেন, 'এ-ও সম্ভব!'
বাঙালি কিন্তু, যোগাসন বা ব্যায়ামটা রামদেবের থেকে শেখেনি। ব্রিটিশ জমানায় এই বাংলা দেশকে একের পর এক ব্যায়ামবীর উপহার দিয়েছে। আয়রনম্যান নীরদ সরকার, নীলমণি দাস, আয়রনম্যান বিষ্ণুচরণ ঘোষ, থেকে পরবর্তী সময়ের লিভিং লেজেন্ড মনোতোষ রায়, মনোহর আইচরা দেখিয়ে দিয়েছেন বাঙালি যোগাসন আর পেশিবহুল চেহারা তৈরিতে কারও চেয়ে কম যায় না।
হিন্দু ধর্মে যোগাসন সাধনার অন্যতম অঙ্গ। সেই যোগকে ভারতে দর্শনের রূপ দিয়েছিলেন মহর্ষি পতঞ্জলি। যাঁর সাধনার ধারা এই বাংলাকে ক্রিয়াযোগ হিসেবে উপহার দিয়েছেন যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ি। যাঁর অন্যতম অনুসারী ছিলেন মুকুন্দলাল ঘোষ ওরফে স্বামী যোগানন্দ পরমহংস। যাঁর খুড়তুতো ভাই হলেন পরবর্তী সময়ের ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষ।
তাঁর জন্ম হয়েছিল অখণ্ড পঞ্জাবের লাহোরে, ১৯০৩ সালের ২৪ জুন। কথিত আছে, অল্পবয়সে মাতৃহারা বিষ্ণুচরণ ছেলেবেলায় বেশ দুর্বল ছিলেন। সেই সময় স্বামী যোগানন্দ তাঁকে নিজের প্রতিষ্ঠিত রাঁচি স্কুল অফ বয়েজে নিয়ে যান। সেখানেই লেখাপড়ার সঙ্গে যোগশিক্ষা লাভ করেন বিষ্ণুচরণ। রাঁচি থেকে স্নাতক হয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক অধিকর্তা রাজেন্দ্র নারায়ণ গুহঠাকুরতা বা রাজেন গুহঠাকুরতার কাছে প্রশিক্ষণ নেন।
শোনা যায়, সেই সময় বিষ্ণুচরণকে বা বিষ্টুচরণ বা বিষ্টু ঘোষকে দেখে গড়পার রোডের এক বিখ্যাত বাঙালি সুকুমার রায় তাঁর 'পালোয়ান' কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতায় তিনি বিষ্টুচরণের নাম দিয়েছিলেন ষষ্ঠীচরণ। লিখেছিলেন, 'খেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতী লোফেন যখন তখন, দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন।' বিষ্ণুচরণ ঘোষ নিজেও সেই সময় থাকতেন গড়পাড়েই। লাল রঙের সেই বাড়ির ঠিকানা- ৪/২, রামমোহন রায় সরণি। বাড়ির সামনে গেলেই চোখে পড়বে বড় করে লেখা- ঘোষ যোগা কলেজ।
সেই সময় উত্তর কলকাতা শরীরচর্চার সেরা কেন্দ্র বলতে বুঝত দুটো জায়গা। এক, যতীন্দ্রচরণ ওরফে গোবর গোহের কুস্তি শিবির। আর, দ্বিতীয়টি বিষ্টু ঘোষের শিবির। ২১ বছর বয়সে বিষ্ণুচরণ যোগাসন আর বডি বিল্ডিংয়ের সমন্বয়ে শরীরচর্চার নতুন ঘরানার জন্ম দিয়েছিলেন। যা, 'ঘোষ টেকনিক' নামে পরিচিত ছিল। যার দৌলতে তিনি বুকের ওপর দিয়ে চলন্ত গাড়ি চলে যাওয়া, ১২ ফুট ওপর থেকে পেটের ওপর কোনও ব্যক্তির আছড়ে পড়া, লোহার মোটা দণ্ডকে বেঁকিয়ে দেওয়ার মত খেলা দেখাতেন।
কলকাতায় তিনি 'ঘোষ কলেজ অফ যোগা অ্যান্ড ফিজিক্যাল কালচার'-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 'Muscle Control and Barbell Excercise' নামে বই লিখেছিলেন। ৮৪টি হঠযোগ ভঙ্গিমার উদ্ভাবন করেছিলেন। জাপানে যোগের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। আমেরিকাতে যোগের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর ছাত্ররা যোগ ও বডি বিল্ডিংয়ের জগতে দিকপাল হয়ে ওঠেন। যেমন, মনোতোষ রায় (প্রথম ভারতীয় মিস্টার ইউনিভার্স), বিক্রম চৌধুরী, বুদ্ধ ঘোষ।
আরও পড়ুন- জগন্নাথের রথের দড়ি টানতে গিয়ে ভয়ংকর ঘটনা! তুমুল উত্তেজনা জালালপুরে
পাশাপাশি, তিনি আইন পাশ করেছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। 'মাননীয় বিচারক' নামে আইন সংক্রান্ত বই লিখেছিলেন। ভারতীয় অলিম্পিক কমিটিতেও তিনি দায়িত্বে ছিলেন। এই মহান যোগবিদ বাঙালি ১৯৭০ সালের ৮ জুলাই ৬৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন।