মেসিদের সমাধি এমবাপের হাতে
ফ্রান্স ৪ (গ্রিজম্যান ১৩' (পেনাল্টি), পভার্ড ৫৭', এমবাপে ৬৪' ও ৬৮')
আর্জেন্তিনা ৩ ( দি মারিয়া ৪', মার্সেডো ৪৮', আগুয়েরো ৯৩')
২০১৭-র ডিসেম্বর। লিগ ওয়ানের এক ম্যাচে প্যারিস সাঁ জাঁরমান খেলছিল লিলির সঙ্গে। ম্যাচটা প্যারিস ৩-১ জিতেছিল। অতিরিক্ত সময় ম্যাচের শেষ গোলটা করেছিলেন কিলিয়ান এমবাপে। ম্যাচের পর লেখালেখি হয়েছিল বছর আঠারোর এমবাপেকে নিয়ে। তাঁর গোলটা তেমন আহামরি ছিল না যে শুধু গোল নিয়ে কালি খরচ হবে। সেদিন এমবাপে ৪৪.৭ কিলোমিটার বেগে ছুটে গোলটা করেছিলেন। গোটা ম্যাচে তাঁর গড় গতিবেগ ছিল ৩৬ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। শুনলে অবাক লাগতে পারে একটা তুলনা টানা হলে। অলিম্পিকে উসেইন বোল্ট ১০০ মিটারের স্প্রিন্টের শুরুটা করেছিলেন ৩৭ কিলোমিটারের কিছু বেশি প্রতি ঘন্টায়। এবার বোঝা যাবে এমবাপের দৌড়টা কোন পর্যায়।
ঘটনাচক্রে আজও শনিবার। আর এদিন এমবাপের দৌড়ে একটা দেশ বিশ্বকাপ থেকেই বেরিয়ে গেল। রাশিয়ায় ফুটবলের মহাযজ্ঞ শুরুর আগে এই এমবাপের ওপরেই বিশেষজ্ঞরা চোখ রাখতে বলেছিলেন। ১৯ বছরের ছেলেটা একাই তছনছ করে দিলেন লা-আলবিসেলেস্তের শিরোপা ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন।
ফ্রান্সের বিপক্ষে ছিলেন এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ ১০ নম্বর জার্সিধারী। নীল-সাদা দেশের মসিহা লিওনেল মেসি। কিন্তু কে জানত যে, আজ শুধু নীল জার্সির ১০ নম্বর খেলোয়াড় হয়ে যাবেন জাতির নায়ক! সারা বিশ্বের কাছে বার্তা দিয়ে রাখলেন, মেসি-রোনাল্ডো-নেইমারের থেকে চোখটা সরানোর সময় হয়ে এসেছে। কাজান জন্ম দিল এক তারার।
এমবাপের পায়েই কিন্তু ম্যাচের রূপরেখা লেখা হল এদিন। দিদিয়ের দেশর ৪-২-৩-১ ছকে অলিভার জিরুদকে সামনে রেখে ফ্রান্সের সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড এমবাপে-গ্রিজম্যান-মাতুইদি। মাঝমাঠে পোগবা-কান্তে। হুগো লরিসের সামনে দেওয়াল তুলে পাভার্ড-ভারান-হার্নান্দেজ। এদিন সাত গোলের থ্রিলার দেখল টুর্নামেন্টের প্রথম নক-আউট। আর ফ্রান্সের অনুকূলে প্রথম পেনাল্টি এল এই এমবাপের জন্য। তাঁর দৌড় থামানোর জন্য গোটা আর্জেন্তিনার রক্ষণ ছুটছে। তাগলিয়াফিকো-রোহো-ওটামেন্ডি-মার্সেডো সবাই আছেন। থামাতে না-পেরে রোহো কনুইয়ের আঘাতে এমবাপেকে ফেললেন ডি-বক্সের মধ্যে। গ্রিজম্যান পেনাল্টিতে ফরাসি বিপ্লবের ডাক দিলেন। প্রথমার্ধে একাধিকবার এমবাপে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে, বিপক্ষের রক্ষণ শুধু নামেই। একের পর এক আক্রমণ কার্যত দিশেহারা করে দিয়েছিল মেসিদের। এর মাঝেই দি মারিয়া ৩৫ গজ দূর থেকে একটা বিদ্যুৎগতির শটে সমতা ফিরিয়ে আনেন।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে নায়ক হয়ে যেতে পারতেন মেসি। কিন্তু তাঁর অবধারিত গোলে নিজের নাম লিখিয়ে দিলেন মার্সেডো। ছ'গজের মধ্যে তাঁর পায়ে বল প্রতিহত হয়ে গোল হয়ে গেল। আর্জেন্তিনার আনন্দের আয়ু ছিল সাত মিনিট। ৫৭ মিনিটে প্যাভার্ড হাফ ভলিতে অসাধারণ একটা গোল করে সমতা ফেরান। আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণে ম্যাচ জমে গেলেও, মেসিদের বিপদ ঘনিয়ে আসছিল সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। ফ্রান্সের আক্রমণের তেজ সূর্যের আলোর মতোই ঝাঁঝাল হয়ে উঠছিল।
বানেগা-মাসচেরানো-পেরেজদের মাঝমাঠ মারিয়া-মেসি-প্যাভনদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছে। ধুঁকছে রক্ষণও। এমবাপে বুঝে গিয়েছিলেন যে, তাঁর রাস্তা আটকানোর কেউ নেই আজ। চার মিনিটের মধ্যে জোড়া গোল করে মেসিদের সমাধি গড়ে দিলেন নিজে হাতে। এরপরই একপ্রকার আর্জেন্তিনার দেশে ফেরার টিকিট পাকা হয়ে যায়, যদিও ম্যাচের ৯৩ মিনিটে আগুয়েরো গোল করে একটা আশা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সময় ছিল না আর। এক গোলে হেরেই আর্জেন্তিনার অভিযান শেষ হয়ে গেল।