পিচগলা রাস্তায় পড়ে স্তূপীকৃত কাঠের কিছু টুকরো। হাতুড়ির বাড়িতে নিমেষের মধ্য়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে নেহাত উনুন ধরানোর জন্যই সেই কাঠের জোগাড় করছেন কেউ। কিন্তু এর মধ্যে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যাওয়ার একটা গল্প। কী সেই স্বপ্ন? একজন ফুটবলারের মত ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। আজ গোটা পৃথিবী FIFA World Cup 2018-এর রাজসূয় যজ্ঞে মাতোয়ারা, কিন্তু কলকাতার গোকুল বড়াল স্ট্রিটের এক অখ্যাত চা-দোকানির গল্প রয়ে গেছে সকলের অগোচরে।
একদম ছোট্টবেলায় বিহারের সমস্তিপুর থেকে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসা সঞ্জীবের বয়স এখন ৪১। সবল, সুঠাম চেহারাটা দেখলে বলে দিতে হয় না, যে তিনি খেলোয়াড়। বস্তুত, আট বছর বয়স থেকেই তাঁর পায়ে ফুটবল। ন্যাশনাল এসি, ক্যালকাটা জিমখানা, গরালগাছি এবং উত্তরপাড়ায় খেলা 'বিহারি বাবু' ইস্ট বেঙ্গলের জুনিয়র টিমেও খেলেছেন। বিকাশ পাঁজি, কৃশানু দে’র মত ফুটবলাররা তাঁর তারিফ করেছেন একসময়। চা বানাতে বানাতেই সঞ্জীব বললেন, “কৃশানু'দা এভাবে চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। আজও মিস করি। কৃশানু'দা, বিকাশ'দা আমাকে স্নেহ করতেন। শুধু বলতেন খেলাটা চালিয়ে যেতে।"
অভাবের সংসারের হাল ধরতেই সঞ্জীবের জীবনটা বদলে যায় রাতারাতি। স্বপ্নের রাজমহলে চিড় ধরার সূত্রপাতও সেখান থেকেই। প্রথমে পেটের তাগিদে 'খেপ ফুটবল' খেলা শুরু করলেন সঞ্জীব। আজ বলেন, "কী করব, খেপ খেলা ছাড়া উপায় ছিল না তখন, প্রচুর কাঁচা টাকা আসত হাতে। চাকরির আশ্বাস পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু চাকরিটা পাওয়া হয়নি।" এসবের মধ্যেই সঞ্জীবের দাদু চলে গেলেন একদিন। সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। দাদুর চায়ের দোকানটাই হয়ে উঠল সঞ্জীবের ধ্যান-জ্ঞান। দোকানের দেখভাল শুরু করেন বাধ্য হয়ে। স্বপ্নের তরী তখনই ভেসে গিয়েছিলে তাঁর। আজও সঞ্জীব একইভাবে সেই দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন।
কাঠ কাটা থেকে শুরু করে কয়লা দেওয়া, এমনকি সন্ধের সময় আটা মেখে রুটিও বানান সঞ্জীব। এসবের মধ্য়েই কিন্তু খেলার সব খবরাখবর রাখেন তিনি। এতটাই খেলা পাগল। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনাল্ডোই সঞ্জীবের আদর্শ, রোনাল্ডোর মতই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সঞ্জীব। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জন্য গলা ফাটাবেন বলেই জানালেন তিনি। বঙ্গজ ফুটবলে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের খেলা ভীষণ পছন্দ করতেন।
আরও পড়ুন: FIFA World Cup 2018: গোর্কি সদনে ফুটবল ফিয়েস্তা, সৌজন্যে মিলি দ্রুগ
বড় ক্লাবের ব্যানার পাননি ঠিকই, কিন্তু ফুটবলটা সঞ্জীব ছাড়েননি আজও। খেলতে না পারুন, রীতিমত একজন ফুটবল প্রশিক্ষক হয়ে উঠেছেন। নোনাপুকুরের সেন্ট অগাস্টিন ডে স্কুলে বাচ্চাদের ফুটবল শেখান তিনি। আবার শনি-রবি সকালে প্র্যাকটিস করান স্থানীয় এক অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের। নিকটবর্তী মেয়েদের স্কুল থেকেও তাঁর ডাক এসেছে ফুটবল শেখানোর জন্য। এমনটাই সঞ্জীব। এই বয়সেও তিনি ফুটবল খেলেন। দোকানেই রয়েছে বিব আর ফুটবল। সরু গলির মধ্যেই অনায়াস দক্ষতায় বল নিয়ে জাগলিং করতে পারেন। পা থেকে মাথা হয়ে বল তাঁর কথা শুনেই ওঠা-নামা করে। পড়শিরা আজও তাঁকে হাঁ করে দেখেন, আর বলে ওঠেন, "দারুণ কাটালি সঞ্জীব!"
ফুটবলার না-হতে পারার করুণ গল্প ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গেও নতুন কিছু নয়। নতুন নয় মধ্য কলকাতার সঞ্জীব সিংয়ের গল্পটাও। কিন্তু কোথাও যেন কিছুটা হলেও আলাদা। জর্জ টেলিগ্রাফ এবং কালীঘাটের মতন ক্লাবে প্রথম ডিভিশন খেলা সঞ্জীবের বড় ক্লাবের জার্সিতে না-খেলার আক্ষেপ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসিও। সব ফুরিয়ে যায়নি।