কাতারে এবার সাম্বার ঢেউ উঠেছে। গ্রুপের প্ৰথম দুই ম্যাচেই সেলেকাও ঝড় উঠেছে। ছিটকে গিয়েছে সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ডের মত নাছোড় ইউরোপীয় শক্তি। শেষ ষোলোয় পৌঁছে গিয়েছে হলুদ সৈনিকরা। আর ব্রাজিলে সাও পাওলোর বাড়িতে বসে প্রিয় ছাত্রদের খেলা উপভোগ করছেন ফুটবল-গুরু। দানিলো, রদ্রিগো, ফ্রেড, উইভার্টন হোক বা বিশ্বকাপে বিস্ময় গোলের মালিক রিচার্লিসন- সকলের উত্থানই কাছ থেকে।দেখেছেন লুইজ গ্রেকো। কলকাতার ময়দানি ফুটবলের সঙ্গে যাঁর নাড়ির টান।
দুর্গাপুরে মোহনবাগান একাডেমির দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় পা রেখেছিলেন ব্রাজিলিয়ান। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় ফুটবলে প্রতিষ্ঠা পান সৌভিক চক্রবর্তী, লালরিনদিকা রালতে, রাম মালিক, তীর্থঙ্কর সরকারদের মত প্রতিভারা। কেউ হারিয়ে গিয়েছেন। কেউ বা দেশের ফুটবলে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছেন। এক বছর পরেই আর্থিক সমস্যার কারণে গ্রেকোর মত গুরুকে ছেড়ে দেয় মোহনবাগান।
মোহনবাগানের প্রাক্তন এই যুব দলের গুরুর সন্নিধ্যেই কিন্তু ফুটবলে হাতেখড়ি ফ্রেড, দ্যানিলো, উইভার্টনদের মত বিশ্ব বন্দিত ব্রাজিলীয় সুপারস্টারদের। ব্রাজিলে বসেই গ্রেকো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন, "রদ্রিগো যখন স্যান্টোসের অনুর্দ্ধ-১৭ দলের ফুটবলার ছিলেন, সেই সময় আমি অনুর্দ্ধ-২৩ দলের টিডির দায়িত্বে। সকলের থেকেই ও আলাদা ছিল। সেই প্রতিভা নজর কেড়েছিল সেই বয়সেই।"
তিন দশক ধরেই পেশাদারি ফুটবলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কখনও যুব দলের কোচ, স্কাউটিং, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর কখনও আবার ট্রেনার, ইউথ ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে জুড়েছেন নিজের নাম। ব্রাজিলের বিখ্যাত আমেরিকা এফসি, ক্রুজেইরো, আতলেতিকো প্যারানেসে, পেলের নাম ধন্য স্যান্টোস বা ইউক্রেনের বিখ্যাত শাখতার দনেস্কে যুক্ত ছিলেন।
জুভেন্টাসে খেলা দানিলো ব্রাজিলের রাইট ব্যাক পজিশনে অপরিহার্য। সুইজারল্যান্ড ম্যাচে এডের মিলিশাওকে নামালেও সার্বিয়া ম্যাচে দানিলোকে রেখেই প্ৰথম একাদশ গড়েছিলেন কোচ তিতে। সেই দানিলোর উত্থান দেখেছেন আমেরিকা এফসিতে থাকার সময়। চাক্ষুস করেছেন নতুন ব্রাজিলের 'কাফু' হয়ে ওঠার পুরোনো সেই দিন।
এলিসন থাকায় আপাতত প্ৰথম এগারোয় জায়গা হচ্ছে না গোলকিপার উয়েভার্টনের। তবে পাইমারেসে খেলা তারকার সঙ্গে মোহনবাগানের প্রাক্তন গুরুর সাক্ষাৎ অবশ্য যুব বয়সে নয়। উয়েভার্টন যখন সিনিয়র পর্যায়ে খেলছিলেন আতলেতিকো প্যারানেসে সেই সময় বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ক্লাবের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর ছিলেন।
ভারতে গোকুলাম কেরালার স্কাউট হিসাবে কাজ করেছেন আর্জেন্টিনীয় কোচ ফার্নান্দো স্যান্তিয়াগোর কোচিং স্টাফে। বর্তমানে আইলিগে খেলা রাউন্ডগ্লাস পাঞ্জাবের প্রধান স্কাউটও তিনি। আর সেই স্কাউটিংয়ের সূত্রেই লুইজ গ্রেকোর সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল ফ্রেডের। তিতের দলের অন্যতম সুপারস্টার বর্তমানে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে রোনাল্ডোর সতীর্থ। ব্রাজিলের ক্লাব থেকে ফ্রেডকে ইউরোপে নিয়ে আসার কারিগর বাগানের প্রাক্তন গুরু গ্রেকো। শাখতার ডনেস্কের স্কাউট থাকার সময়েই নিজের দেশে স্পট করেছিলেন সেই সময় ইন্টারন্যাশিওনেলে খেলা ফ্রেডকে। তারপরে শাখতারে তিনি নিয়ে আসেন ফ্রেডকে।
টানা পাঁচ বছর ইউক্রেনের সেরা ক্লাবে খেলার পর বর্তমানে তিনি রেড ডেভিলসদের অন্যতম সৈনিক।
রিচার্লিসনের সঙ্গে গ্রেকোর অবশ্য সরাসরি সাক্ষাৎ নেই। তবে আমেরিকা এফসি দুজনের ভাগ্য জুড়ে দিয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে ব্রাজিলিয়ান মায়েস্ত্র বলছিলেন, "বেলো হরাইজন্তের আমেরিকা এফসির সৌজন্যে ওঁর সঙ্গে আমার কানেকশন। সরাসরি কোচ/ফুটবলার সম্পর্ক ছিল না যদিও। ১৭ বছর ধরে আমেরিকা এফসির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম দুটো স্পেলে। প্ৰথম স্পেলে ১৯৮০-৯০ এ টানা দশ বছর ফিজিক্যাল ট্রেনার ছিলাম। দ্বিতীয় বার যুব দল এবং আন্তর্জাতিক রিলেশনের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছি ১৯৯৭-২০০৪ পর্যন্ত। সেই সময় বহু আন্তর্জাতিক ফুটবলারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তবে রিচার্লিসন ২০১৩-য় আমেরিকা এফসিতে এসেছিল। ও তখন ১৬ বছরের। আমিও তখন ক্লাবে ছিলাম না।"
নেইমার, ফ্রেড, রিচার্লিসন, দানিলো, মার্কুইনহোসরা স্বপ্ন ছোঁয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন মরু-রাজ্যে। দুই দশক পর বিশ্বকে সাম্বা ঝড়ে ভাসিয়ে এভারেস্টে ওঠার শপথ নিয়েছেন তিতের ছেলেরা। আর প্রিয় শিষ্যদের হাতে যে সেলেকাওদের পরম্পরা বয়ে চলেছে, তা দেখেই তৃপ্তি ঢেঁকুর তুলছেন বাগানের ব্রাজিলীয় মহা-গুরু!