ফ্রান্স: ৩ (২) (এমবাপে-হ্যাটট্রিক)
আর্জেন্টিনা: ৩ (৪) (মেসি-২, ডি মারিয়া )
সর্বশ্রেষ্ঠ মেসিই। কাতারের লুসেইল স্টেডিয়াম সমস্ত তর্কের অবসান ঘটিয়ে গেল। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি রবিবার রাতের পর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। পেলে না মারাদোনা কে শ্রেষ্ঠ, এই জল্পনার অবসান ঘটিয়ে গেল লুসেইল স্টেডিয়াম। মেসিই সেরা। সবসময়ের। সব যুগের।
কার্যত একপেশে ম্যাচ। সেই ম্যাচেই চরম টেনশন। তুমুল উত্তেজনা শেষ ৪৫ মিনিট। এমবাপের হ্যাটট্রিক। দু-বার পিছিয়ে পরেও ফ্রান্সের ভেঙে না পড়া। এবং কিলিয়ান এমবাপের বুলেট পায়ে ফ্রান্সের স্বপ্ন বেঁচে থাকা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
তবু সব বাধা উড়িয়ে মেসিকে রূপকথার, তাঁর কেরিয়ারের সেরা রাত উপহার দিয়ে গেলেন দুজন- একজন দিমারিয়া। অন্যজন এমি মার্টিনেজ। প্রথমজন, ক্লিনিক্যাল ফিনিশে প্রথমার্ধে ২-০ এগিয়ে দিয়ে একদম দুমড়ে মুচড়ে দিলেন ফ্রান্সের দর্প। দ্বিতীয়জন নেদারল্যান্ডস ম্যাচের মতই ফ্রান্সের হৃদয় ভেঙে দিলেন টাইব্রেকারে।
আরও পড়ুন: এমবাপের হ্যাটট্রিকে হাতছাড়া গোল্ডেন বুট! চ্যাম্পিয়ন মেসির কাছেই সোনালি বল, আর কে কী পুরস্কার পেলেন
বিরতির আগেই জোড়া গোল। পেনাল্টি থেকে মেসির গোলের পর দিমারিয়র চমৎকার ফিনিশ। ৭৫ মিনিট পর্যন্ত মনে হচ্ছিল মাঠে একটা দলই খেলছে। নিজেদের ইচ্ছা মত পাস খেলছে। বল পজেশন রাখছে। বিপক্ষ অর্ধে হানা দিচ্ছে। কোথায় ফ্রান্স। কোথায় এমবাপে। দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না দুর্ধর্ষ ফরাসিদের।
সেই ম্যাচই যে এমন রোমহর্ষক জায়গায় পৌঁছে যাবে কে ভাবতে পেরেছিল। কে ভাবতে পেরেছিল ৮০ মিনিটে ২-০ লিড, ১১৫ মিনিটে ৩-২ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ম্যাচ গড়াবে টাইব্রেকারে। গা ছাড়া মনোভাব, নাকি শেষ কোয়ার্টারে দিদিয়ের দেশচ্যাম্পের তুখোড় ট্যাকটিক্স, তা নিয়ে আলোচনা চলবে আগামীদিনে।
তবে ফাইনাল হল ফাইনালের মত। শেষ ১৫ মিনিট আর্জেন্টিনার হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে ম্যাচ প্রায় বের করে নিচ্ছিলেন নীল জার্সির ফুটবলাররা। গোটা ম্যাচেই নিষ্প্রভ থাকা এমবাপে জ্বলে উঠলেন এই লগ্নেই।
কেন তাঁকে বিশ্বফুটবলের আগামী দিনের সবথেকে উত্তেজক তারকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তার সার্থক উদাহরণ হয়ে থাকবে এই ম্যাচ। নিজে গোলার মত ভলিতে গোল করলেন। পেনাল্টি থেকে দু-দু বার জালে বল রাখলেন বাজপাখি মার্টিনেজকে পেরিয়ে।
প্রথমার্ধে ফ্রান্সকে কার্যত দাঁড়াতেই দেয়নি আর্জেন্টিনা। প্ৰথম ২২ মিনিট তো আর্জেন্টিনা বক্সে ফ্রান্সের একটা টাচও নেই। সাধারণত এমবাপে এবং দেম্বলের ড্রিবল এবং গ্রিজম্যানের লেট রান ফ্রান্সের সম্পদ। এই ছকে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা অনেকটা ওপরে উঠে যাওয়ায় স্পেস পেয়ে যেতেন ফরাসিরা।
তবে প্ৰথম গোল হজম করতে হল দেম্বলের ব্যক্তিগত ভুলের খেসারত দিয়ে। উইং ধরে ডি মারিয়া কাট করে ভিতরে ঢুকে পড়লে ফাউল করে বসেন ফরাসি মিডফিল্ডার। সেই পেনাল্টি থেকেই মেসির চলতি বিশ্বকাপে ষষ্ঠ গোল। নার্ভের খেলা চলছিল গোটা ম্যাচ জুড়েই। মেসি সেই খেলায় কেরিয়ারের সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গোল করে গেলেন। হুগো লরিসকে বাঁ দিকে ছিটকে দিয়ে তিনি বল ঠেললেন ডানদিকে। তারপরে দু-হাত প্রসারিত করে তিনি বাজপাখি হলেন। সতীর্থদের আলিঙ্গনে চাপা পড়ে গেলেন।
দ্বিতীয় গোলেও মেসির পা। ৪০ গজ দূর থেকে বল পেয়েই নো লুক থ্রু বল বেড়িয়েছিলেন। দুটো টাচেই কেঁপে গেল ফ্রান্সের ডিফেন্স। কাউন্টার এটাকে আলভারেজকে ছোঁয়ার সাধ্যি ছিল না ভারানেদের। তবে আলভারেজ নিজে গোল করলেন না। বাঁ দিকে অরক্ষিত থাকা ডি মারিয়াকে বল বাড়ালেন। সেখান থেকে লরিসকে পেরিয়ে জালে জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ৩৪ বছরের সুপারস্টার।
জোড়া গোল হজম করার পর সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি দিদিয়ের দেশচ্যাম্প। সঙ্গেসঙ্গেই জিরো, দেম্বলেকে তুলে নামিয়ে দেন কোলো মুয়ানি এবং থুরামকে যারা মরক্কো ম্যাচে নেমেই পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলেন। এই প্ৰথমবার কোনও বিশ্বকাপের ফাইনালে কোনও দল দুজনকে চেঞ্জ করল।
আর্জেন্টিনার গোলমুখে শট নিতে ৬৭ মিনিট লাগিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্স। ফ্রান্সকে আটকানোর জন্য কোচ স্কালোনির গেমপ্ল্যান খুব স্পষ্ট ছিল। রাইট উইংয়ে ডি পল এবং তার নীচে উইং ব্যাক হিসাবে নাহুয়েল মলিনা। এতেই শান্ত ছিলেন কিলিয়ান এমবাপে। মাঝমাঠে রাজত্ব করছিলেন এনজো ফার্নান্দেজ। ফ্রান্স মাঝমাঠে কোনও স্পেসই পাচ্ছিল না। বলে পজেশন আর্জেন্টিনার দখলে থাকায় হাইপ্রেস করতেও সাহস পাচ্ছিল না ফ্রান্স। ডি পল এবং মলিনা ফ্রান্সের ফরোয়ার্ডদের কোনও জায়গাই দিচ্ছিলেন না।
তবে কোচ দেশচ্যাম্পকে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁর সুপার-সাবরা। ৪১ মিনিটে কোলো মুয়ানিকে নামানো হয়েছিল। তিনিই ফ্রান্সকে লাইফলাইন দিলেন পেনাল্টি আদায় করে। সেখান থেকেই ৮০ মিনিটে লো শটে ২-১ করে যান এমবাপে। ঠিক তাঁর পরের মিনিটেই আর্জেন্টিনার বুকে মাটি ফেলে দুর্দান্ত ভলিতে ২-২ করে যান মেসি-রোনাল্ডো পরবর্তী সময়ের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।
মাত্র ১ মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোল হজম করে হঠাৎ করেই খেই হারিয়ে ফেলে আর্জেন্টিনা। আসলে জোড়া পরিবর্ত নামিয়ে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন কোচ দেশচ্যাম্প।
কামাভিঙ্গা-কিংসলে কোমান জুটি মাঝমাঠে ডুয়েল গুলো জিততে শুরু করলেন। জিদান, পেলে, ভাভা-র মত দুটো বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার নজির গড়ে ফেলেছিলেন।
নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলার শেষে ২-২। অতিরিক্ত সময়ে মেসি ম্যাজিকে আর্জেন্টিনা ৩-০ করেও ফেলে। তবে শেষ ৫ মিনিটেই ফের পেন্ডুলামের মত দুলে গেল ম্যাচ। এমবাপের শট ব্লক করতে গিয়ে হ্যান্ডবল করে বসেন মলিনা। সেখান থেকেই ১১৮ মিনিটে এমবাপের দ্বিতীয় পেনাল্টি থেকে ৩-৩ করে যায় ফ্রান্স।
টাইব্রেকারে ৩৬ বছরের বুড়ো হুগো লরিসের ম্যাচ বের করা কঠিন ছিল জানাই কথা। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় কিংসলে কোমানের শট রুখে দেন মার্টিনেজ। তারপরের শট চুয়ামেনি মিস করার লড়াই কার্যত নিশ্চিত হয়ে যায় কাপ মেসির হাতেই উঠতে চলেছে। মনটিয়েলের শট জালে জড়াতেই বিষ্ফোরণ। যে বিষ্ফোরণ একসঙ্গে বসিয়ে দিল মেসি, মারাদোনাকে। আর্জেন্টিনাকে তিন দশকের ট্রফি খরা কাটিয়ে দিল এক লহমায়।