ইতিহাসে পৌঁছে গিয়েছেন মরক্কোর গোলকিপার ইয়াসিন বোনু। ২০১০-এর চ্যাম্পিয়নরা যাঁর হাতে ছিটকে গেল সেই ইয়াসিনের জন্ম, বেড়ে ওঠা সব-ই মরক্কোর বাইরে। ম্যাচের পরেই স্পেনের সেভিয়ায় খেলা গোলকিপার বলে দিয়েছেন, "পেনাল্টি কিছু আন্দাজ আর কিছুটা ভাগ্যের ব্যাপার।"
কয়েক বছর আগে একইভাবে সেভিয়ায় হয়ে খেলতে নেমে আটকে দিয়েছিলেন দুর্ধর্ষ ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডকে। সেভিয়ায় বরাবর ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার বোনু। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেদিন তিনি হাফডজন গোল বাঁচিয়ে ছিলেন। ইউরোপা লিগের নক আউট পর্বের ম্যাচে এন্থনি মার্শালের একের পর এক শট আটকে দেন তিনি। শেষমেশ সেই ম্যাচে ২-১ হারিয়ে টুর্নামেন্টে শেষ পর্যন্ত ইউরোপা লিগ জেতে সেভিয়া। আর সেই জয়ের নেপথ্যে তাঁদের মরোক্কান গোলকিপার।
আরও পড়ুন: ‘লজ্জা লাগা দরকার’! রোনাল্ডোকে বাদ দিতেই পর্তুগাল কোচকে বীভৎস আক্রমণ মিসেস রোনাল্ডোর
দোহাতে মরক্কোর স্বপ্নের দৌড় চলছে। যাঁদের হাতে বধ হয়েছে একের পর এক হেভিওয়েট। প্ৰথমে গ্রুপ পর্বে বেলজিয়াম, কানাডা। এখন নকআউটে স্পেনেরও ছুটি করে দিল মরোক্কানরা। গতবারের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়াকেও চলতি বিশ্বকাপে রুখে দিয়েছে তাঁরা। টুর্নামেন্টে ৪০০ মিনিট খেলার পরে মরক্কো গোল হজম করেছে মাত্র ১টি।
জন্ম কানাডার মন্ট্রিয়েলের কিউবেকে। শরণার্থী মরোক্কান বাবা-মা'র সন্তান এই ইয়াসিন। জন্ম এবং বংশগত সূত্রে কানাডা অথবা মরক্কো যে কোনও দেশের দলেই নাম লেখানোর সুযোগ ছিল তাঁর কাছে। কানাডার জন্ম হলেই ফুটবলে হাতেখড়ি মরোক্কান লিগে খেলে। আফ্রিকান ক্লাব ফুটবলের সেরা লিগ সিএএফ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের তিনবারের জয়ী ক্লাব ওয়াইদাদ ক্লাসাব্লাঙ্কাতে তিনি যোগ দেন ২০১১-এ।
মরোক্কান ক্লাবটির হয়ে বেশ কয়েক বছর খেলার পরে আতলেতিকো মাদ্রিদের বি দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। যে দলের হয়ে তিনি দু-বছরে ৪৭টি ম্যাচ খেলবেন পরবর্তীতে। আতলেতিকো বি দলের হাত ধরেই টানা গত একদশক খেলে চলেছেন স্প্যানিশ লিগে। খেলেছেন আতলেতিকো মাদ্রিদের সিনিয়র দল, রিয়েল জারাগোজা, জিরোনার মত ক্লাবে।
আরও পড়ুন: টাইব্রেকারের থ্রিলারে মরক্কোর কাছে স্বপ্নভঙ্গ স্পেনের, চোখের জলে বিশ্বকাপ শেষ মোরাতাদের
স্পেনে কেরিয়ারের সেরা সময় অবশ্য কাটিয়েছেন সেভিয়ার হয়ে। সেভিয়ার ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার হিসাবে ৭৬ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন গত কয়েক বছরে। দলকে ইউরোওয়া লিগের খেতাবও জিতিয়েছেন। ফাইনালে ইন্টার মিলানকে হারিয়ে।
ঘটনা হল, কয়েক বছর আগেই ২০১৮-য় আইএসএল-এ খেলা মুম্বই সিটি এফসি, কেরালা ব্লাস্টার্সকে নিয়ে একটি প্রীতি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে লা লিগার জিরোনা এফসি, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, মেলবোর্ন সিটির মত প্ৰথম সরিয়ে ক্লাব খেলে গিয়েছিল। আর জিরোনার হয়েই ভারতে খেলে গিয়েছিলেন মরক্কোর জাতীয় দলের বর্তমান সুপারস্টার গোলকিপার ইয়াসিন বোনু।
সেই ম্যাচে কেরালা কোচ ডেভিড জেমসের সমস্ত স্ট্র্যাটেজি খড়কুটোর মত উড়িয়ে দিয়েছিলেন জিরোনা কোচ ইউসেবিও স্যাক্রিস্টান। কেরালার হয়ে সেবার জিরোনার হয়ে মাঠে নেমেছিলেন হোলিচরণ নার্জারি, সেমিলেন ডঙ্গেল, মহম্মদ রাকিপ, নবীন কুমার, ধীরাজ সিং, জাকির মুন্ডাপারা। কেরালার বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন পেকুসন, নেমানজা ল্যাকিচরা। সেই ম্যাচে ০-৫ গোলে হারে কেরালা ব্লাস্টার্স। জিরোনার হয়ে সেবার পাঁচ গোল করে যান এরিক মন্তেস, পেদ্রো পরো, আলেক্স গ্রানেল, এদে বেনিতেজ, আলেক্স সেরেনোরা। কেরালার জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়ামে কার্যত কোনও পরিশ্রমই করতে হয়নি বোনুকে।
আরও পড়ুন: রোনাল্ডো বাদ পড়তেই বিশ্বকাপের প্ৰথম হ্যাটট্রিক, ৬ গোলের বন্যা বইয়ে শেষ ৮-এ পর্তুগাল
স্পেনকে হারানোর পরে মরোক্কার সমর্থক এবং সাংবাদিকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। অবিশ্বাস্য জয়ে চোখের জল বাঁধ মানছিল না। মিডিয়া ট্রিবিউনে এক সাংবাদিককে দেখা গেল হাউহাউ করে কাঁদতে। অন্য এক সাংবাদিক বোনু এবং ম্যানেজার ওয়ালিদ রেগ্রাগুউকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন।
ভৌগলিকভাবে মরক্কো এবং স্পেন নিকটবর্তী দেশ হওয়ায় স্পেনে বহু মরোক্কান শরণার্থীর বাস। ২০২১/২২ সিজনে লা লিগার তরফে 'আফ্রিকান মোস্ট ভ্যাকুয়েবল প্লেয়ার' পুরস্কার চালু করা হয়। বোনুই প্ৰথম সেই পুরস্কার জেতেন।
মরক্কো পরের ম্যাচে মুখোমুখি হবে পর্তুগালের বিরুদ্ধে। দুই দলের রক্ষণই টুর্নামেন্টে নজরকাড়া পারফরম্যান্স মেলে ধরেছে। রোনাল্ডোকে বাদ দিয়েই যে দল বিপক্ষকে হাফডজন গোল দিতে পারে, তাঁদের বিরুদ্ধে মরোক্কার রক্ষণের স্ট্র্যাটেজি কেমন হয়, তা দেখতে মরিয়া ফুটবল বিশ্ব।