Advertisment

FIFA World Cup 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে (তৃতীয় পর্ব)

আগের পর্বে লিখেছিলাম গ্রুপ লিগের প্রথম কয়েকটা ম্যাচ নিয়ে। তারপর এক সপ্তাহে বেশ কিছু খেলা হয়ে গেছে। এখন আপনারা জানেন শেষ ষোলোয় কারা ঢুকে পড়েছে, কারাই বা অপ্রত্যাশিতভাবে ছিটকে গেল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
FIFA World Cup 2018 trivia

FIFA World Cup 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে (তৃতীয় পর্ব)

Football World Cup Trivia 2018:

Advertisment

মিঠুন ভৌমিক

আগের পর্বে লিখেছিলাম গ্রুপ লিগের প্রথম কয়েকটা ম্যাচ নিয়ে। তারপর এক সপ্তাহে বেশ কিছু খেলা হয়ে গেছে। এখন আপনারা জানেন শেষ ষোলোয় কারা ঢুকে পড়েছে, কারাই বা অপ্রত্যাশিতভাবে ছিটকে গেল। নড়বড় করতে করতে ব্রাজিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ান হয়ে গেছে, জার্মানির মত হেভিওয়েট দল ছিটকে গেছে এবং ক্রোয়েশিয়ার কাছে তিনগোলে হারের পরও আর্জেন্তিনা উঠে পড়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে।

বিশেষত জার্মানির অকাল-বিদায় নিয়ে উদ্বেলতা খুবই যুক্তিসঙ্গত। বারোবার তৃতীয় স্থান বা তার থেকে ভালো ফল করেছে জার্মানি, চারবারের কাপজয়ী তারা, এবং আটবারের ফাইনালিস্ট (১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৭৪, ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০, ২০০২, ও ২০১৪)। এত ভালো রেকর্ড আর কারো নেই। জার্মানি বিশ্বকাপ খেলেছে তিনটে ভিন্ন নামে। ১৯৩০-৩৮ যে জার্মান দল বিশ্বকাপ খেলেছে তাদের আলাদা করে ধরা হয় নাৎসি আমলের জন্য। ১৯৫০-৯০ এর মধ্যে বিশ্বকাপ খেলেছে পশ্চিম জার্মানি, আর ১৯৯৪ সাল থেকে আবার অখণ্ড জার্মানি হিসেবে তাদের অভিযান।

আরও পড়ুন: World Cup Trivia 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে (দ্বিতীয় পর্ব)

এহেন দল যখন তিন ম্যাচে তিন পয়েন্ট নিয়ে বিদায় নেয়, তাও মেক্সিকো ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে, তখন সেটা নড়েচড়ে বসার মত ঘটনাই। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে খেলায় জার্মানরা যেসব সিটার মিস করেছে, সেগুলো থেকে গোল না করা পেশাদার ফুটবলে অপরাধ। অবশ্য বিশ্বকাপে এরকম অঘটন হামেশাই ঘটে। শুধু শেষ কয়েক বছরের বিশ্বকাপ ঘেঁটে দেখলেই জানা যাবে বেশ কিছু ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ান দল প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিয়েছে (১৯৯৮ সালে ফ্রান্স, ২০০৬ সালে ইতালি, ২০১০ সালে স্পেন, এবং ২০১৪ সালে জার্মানি)।

জার্মানি প্রসঙ্গে একটা অন্য গল্প বলে শেষ করি। ১৯৮২ সালের স্পেন বিশ্বকাপ। আলজিরিয়া সেবার খুব ভালো খেলছে, গ্রুপের শেষ ম্যাচে চিলিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে দেওয়ায় প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে তাদের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে। যদি না জার্মানি বনাম অস্ট্রিয়ার খেলায় জার্মানি ১-০ বা ২-০ জেতে। সেক্ষেত্রে দুই দলই উঠবে দ্বিতীয় রাউন্ডে, বিদায় নেবে আলজিরিয়া। জার্মানি-অস্ট্রিয়া ম্যাচে দশ মিনিটের মধ্যে জার্মানি একগোলে এগিয়ে যায়। এরপর যা হয় তা ন্যক্কারজনক। পরবর্তী আশি মিনিটের ফুটবলে দুই দল পরষ্পরের গোলে কোনও শট নেয়নি, কেউ কাউকে ট্যাকল করেনি, খুব কম বিরল কিছু মুহূর্তে কেউ কার্যকরী আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে।

আরও পড়ুন: FIFA World Cup 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে

অস্ট্রিয়া নিয়ে কিছু বলার নেই, কিন্তু সেবারের জার্মানি (অর্থাৎ পশ্চিম জার্মানি) অসম্ভব শক্তিশালী দল, পরে তারা ফাইনালেও উঠেছিলো। এই আচরণের জন্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া প্রবল সমালোচিত হয়, তাদের নিজেদের দেশের মিডিয়াই ফিফার কাছে আবেদন করে যেন দলদুটির শাস্তি হয়। প্রমাণের অভাবে ফিফা কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে পরের বিশ্বকাপ থেকে নতুন নিয়ম আসে। ঠিক হয়, গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচগুলোয় একই গ্রুপের দল একই সঙ্গে খেলতে নামবে, যাতে কেউ অন্য খেলার ফল জেনে নিজেদের খেলায় তার সুবিধা নিতে না পারে।

এই বিশ্বকাপে দুটি আফ্রিকার দেশ নাইজিরিয়া ও সেনেগাল অংশ নিয়েছিলো, এবং তারা বিদায় নিয়েছে। এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু কিছু হাহুতাশ চোখে পড়লো। আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ফুটবলও আসলে শুধু খেলা নয়, তার একটি স্তরে যেমন অপূর্ব সুন্দর সৌভ্রাতৃত্বের ছবি, অন্য স্তরে তেমনই বাসা বেঁধে আছে চিরকালীন রাজনীতি, যার নিজস্ব ভাষা রয়েছে। অন্যায়ভাবে ছিটকে গিয়ে আলজিরিয়া একেবারেই ভেঙে পড়েনি, তাদের আক্রমণভাগের খেলোয়াড় বেলোমি বলেছিলেন,

" Our performances forced FIFA to make that change, and that was even better than a victory, it meant that Algeria left an indelible mark on football history".

ব্রাজিলকে বাদ দিয়ে ফুটবলের কোনও আলোচনাই বেশিদূর এগোয় না। এই সীমাহীন প্রভাব, বিশ্বের অন্য কোন দলের নেই। এবারের ব্রাজিল দল খুবই গতিশীল, আক্রমণাত্মক এবং তাদের চিরাচরিত ছন্দোময় ফুটবল খেলছে, যদিও প্রথম দুটি ম্যাচে তাদের সমর্থকেরা খুবই উদ্বেগে কাটিয়েছেন। ব্রাজিলকে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বকাপের সবথেকে সফল দল বলা যেতে পারে। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ান (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৮৭০, ১৯৯৪, ২০০২), দুবার করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ স্থান পাওয়া বা ১০৭ ম্যাচে ৭০ টা জয় ও মাত্র ১৭টি পরাজয়। স্রেফ এই তথ্যগুলো দিয়ে ব্রাজিলকে বিচার করা যায়না।

আরও পড়ুন: History of Soccer: ফুটবলায়নের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব)

বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিল এক ফুটবলদর্শন হিসেবে পরিচিত, প্রায়শই যা প্রতিযোগিতার থেকেও বড়ো হয়ে গেছে। ব্রাজিল একাধারে সবথেকে বেশি ফুটবল ট্র্যাজেডিরও অংশীদার। যেকোন ট্র্যাজেডিই উজ্জ্বল হয়ে থাকে কাব্যে, তাই জিকো-ফালকাও-এডার-সক্রেতিসের ১৯৮২ সালের ব্রাজিল দল কোন কাপ না জিতেও ঠাঁই পেয়েছে সর্বকালের সেরাদের মধ্যে। সার্বিয়াকে দু-গোলে হারিয়ে ব্রাজিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ান হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে, খেলতে হবে মেক্সিকোর সাথে।

২০১৪ সালের গ্রীষ্মে কর্মসূত্রে মেক্সিকোয় ছিলাম। গ্রুপ লিগের খেলায় ব্রাজিল সেদিন খেলছে মেক্সিকোর সাথে। মেক্সিকো সিটি থেকে দক্ষিণে ঘন্টা দুয়েক দূরে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত কুয়ার্নাভাকায় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকোর ক্যাম্পাসে সেদিন কেউ কাজ করছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্লাসরুমে প্রজেক্টার তো থাকেই, সেখানে টিভির কানেকশান দেওয়া হয়েছে। প্রফেসর থেকে ছাত্র সবাই ঠাসাঠাসি করে বসে দাঁড়িয়ে দেখছে ম্যাচ। একেকবার ব্রাজিল আক্রমণে আসছে, আটকে যাচ্ছে আর উল্লাসে ফেটে পড়ছে সবাই। মেক্সিকোর গোলরক্ষক ওচোয়া নিশ্চিৎ কিছু গোল বাঁচিয়ে সেদিন নায়ক। খেলা ড্র হওয়ায় সেদিন ভারি খুশি হয়েছিলাম। পৃথিবীর এই অর্ধে ফুটবল মানে কী জিনিস, তা যাঁরা এর মধ্যে না থেকেছেন, বুঝবেন না।

আরও পড়ুন: ফুটবলায়নের দিনগুলি- পৃথিবীজোড়া ফুটবল চর্চার ইতিহাস

লাতিন আমেরিকান ফুটবল নিয়ে যখন কথা হচ্ছেই, একটা মজার ট্রিভিয়া রাখা থাক। ১৯৭৪ এর বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড দুর্ধর্ষ দল। সারা বিশ্ব হইচই করছে "টোটাল ফুটবল" নিয়ে। সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ড পরপর দুটো ম্যাচে আর্জেন্তিনাকে ৪-০ ও ব্রাজিলকে ২-০ হারায়। তার আগের রাউন্ডেই উরুগুয়েকে ২-০ হারানোয় নেদারল্যান্ডই প্রথম দল হিসেবে একই বিশ্বকাপে সমস্ত অংশগ্রহণকারী দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোকে হারানোর বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে।

এই লেখা শেষ করবো ইংল্যান্ডের কথা দিয়ে, যেখান থেকে আধুনিক ফুটবলের সূচনা বলে বেশিরভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক মনে করেন। নিজেদের দেশে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ জয় বাদ দিলে ইংল্যান্ডের ঝুলিতে পড়ে থাকে শুধু ১৯৯০ সালের চতুর্থ স্থান। সবথেকে বেশি গোলশূন্য ড্র করার রেকর্ড আছে ইংল্যান্ডের। দেশের মাটিতে খেলা সবথেকে সফল দল বলা হয় ইংল্যান্ডকে, কারণ ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়ানশিপ বলে একশো বছর ধরে চলা একটি প্রতিযোগিতা (১৮৮৪-১৯৮৪)। এই প্রতিযোগিতায় শুধু ইউনাইটেড কিংডমের অন্তর্গত চারটি দেশ খেলতো (স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস এবং ইংল্যান্ড)। সেখানে ৫৪ বার বিজয়ী হওয়ার সুবাদে ইংল্যান্ড ঘরের মাঠে অপ্রতিরোধ্য দল হিসেবে পরিচিত হয়। প্রসঙ্গত, ১৯৬৬ সালের পর থেকে ইংল্যান্ড বা ইউনাইটেড কিংডমের কোথাও বিশ্বকাপের আসর বসেনি।

পরের পর্ব আসতে আসতে খেলা আরো জমে উঠবে, ঠিক হয়ে যাবে কোয়ার্টার ফাইনালিস্টদের নাম। পরের পর্বে আমরা দেখে নেবো নক-আউট পর্বের ইতিহাস, কোন দল কেমন করেছে অতীতে।

(সঙ্গের ছবি www.kremlin.ru থেকে, উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে প্রাপ্ত।)

FIFA WORLD CUP 2018
Advertisment