নক্ষত্রপতন বললে কমই বলা হয়। ভারতীয় ক্রীড়াজগতে মহানক্ষত্রপতন। শুক্রবার দুপুরে প্রয়াত কিংবদন্তি ফুটবলার এবং কোচ প্রদীপ কুমার ব্যানার্জি (পিকে)। কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর জীবনযুদ্ধ থেমে গেল ৮৩ বছরের পিকে-র। পার্কিনসন্স ডিজিজ, ফুসফুসের সমস্যা, হৃদযন্ত্রের অসুবিধে সহ একাধিক সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন পিকে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়া-ঘটিত সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২ মার্চ ভেন্টিলেটরে রাখা হয় প্রবাদপ্রতিম এই ফুটবলারকে। হাসপাতাল সূত্রে ৪ মার্চ জানানো হয়, চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন পিকে। কিন্তু ফের শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি শুরু হয়। আজ সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। পিকে-র প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলা সহ সারা দেশের ক্রীড়ামহল। আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় ফুটবলে যুগাবসান।
১৯৩৬-এর ২৩ জুন পিকে-র জন্ম হয় জলপাইগুড়িতে। পড়াশুনো করেন প্রথমে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, এবং পরে জামশেদপুরের একটি স্কুলে। কিশোর বয়সেই বিস্ময়কর ফুটবল প্রতিভার সৌজন্যে মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিকে স্থান পান বিহারের সন্তোষ ট্রফি দলে। ১৯৫৪-য় পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায়। যোগ দেন এরিয়ান টিমে। রেলে চাকরি পাওয়ার পর খেলতে শুরু করেন ইস্টার্ন রেলওয়ের হয়ে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ১৯৫৫ সালে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটে পিকে-র। এখানে এটাও বলে রাখা জরুরি, কলকাতা ফুটবলে আগাগোড়া খেলেছেন ইস্টার্ন রেলওয়ের হয়ে। এবং পিকে-র সৌজন্যেই ১৯৫৮ সালে কলকাতা লিগ জিতেছিল ইস্টার্ন রেল। স্বাধীনতার পরে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডান বাদে সেই প্রথম অন্য কোনও ক্লাব লিগ জিতেছিল। ইতিহাস তৈরি হয়েছিল পিকে-র পায়ে ভর দিয়েই।
দেশের হয়ে টানা দশ বছর স্ট্রাইকার হিসেবে দাপটে খেলেছেন পিকে, রেখে গিয়েছেন একাধিক অনন্য মাইলস্টোন এবং নিজের ফুটবল প্রতিভার ধারাবাহিক সাক্ষর। তিনটে এশিয়ান গেমসে দেশের হয়ে খেলেছেন পিকে। ১৯৫৮-য় টোকিও, '৬২-তে জাকার্তা এবং '৬৬-তে ব্যাঙ্কক। ১৯৬২-র এশিয়াডে ভারতীয় ফুটবল দলের সোনা জয়ের নেপথ্যে পিকে-র দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্সের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। খেলেছেন ১৯৫৬-র মেলবোর্ন অলিম্পিক এবং ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিকে। রহিম সাহেবের কোচিংয়ে পিকে-র ক্যাপ্টেন্সিতে রোম অলিম্পিকে ভারতের পারফরম্যান্স লোকগাথায় ঢুকে গেছে। প্রবল শক্তিশালী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করেছিল ভারত। পিকে দুরন্ত গোল করেছিলেন। পিকে-চুনী-বলরামকে নিয়ে গড়া ভারতীয় ফরোয়ার্ড লাইনকে সে সময় সমীহের চোখে দেখত আন্তর্জাতিক ফুটবল মহলও।
#OnThisDay in 1962, India defeated Thailand 4-1 in second group game of Asian Games. Goals came from PK Banerjee (2), Chuni Goswami & Tulsidas Balaram. Unfortunately, Jarnail Singh picked up a serious head injury that required over half a dozen stitches #IndianFootball pic.twitter.com/t7vpx3GBe6
— IndianFootball_History (@IndianfootballH) August 28, 2019
কুয়ালা লামপুরে মারডেকা কাপে তিনবার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। মারডেকায় ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪-তে ফুটবলে ভারতের রূপো এবং ১৯৬৫-তে ব্রোঞ্জ জয়েও পিকে-র দুর্দান্ত ভূমিকা ছিল। অভূতপূর্ব সফল কেরিয়ারের পর চোট-আঘাত জনিত নানা সমস্যার কারণে অবসর নেন ১৯৬৭-তে। দেশের জার্সি গায়ে ৮৪টি ম্যাচে পিকে-র গোলসংখ্যা ৬৫।
সাফল্য-ঝলমল কেরিয়ার বহু বিরল সম্মান এনে দিয়েছে পিকে-কে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে 'অর্জুন' পুরস্কার পেয়েছেন, ১৯৯০ সালে পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী' সম্মান। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফুটবল হিস্ট্রি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স তাঁকে বিশ শতকের সেরা ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সর্বোপরি, ২০০৪ সালে পেয়েছেন 'ফিফা অর্ডার অফ মেরিট', ফিফার সর্বোচ্চ সম্মান। পিকে-ই এ যাবৎ একমাত্র ভারতীয় ফুটবলার, যিনি অলিম্পিক কমিটির 'ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার প্লে' পুরস্কার পেয়েছেন।
সব বড় ফুটবলার বড় কোচ হন না। প্রদীপ কুমার ব্যানার্জি ছিলেন ব্যতিক্রম। শুধু ফুটবলার হিসেবেই নন, কোচ হিসেবেও পিকে নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় তিন দশকেরও বেশি কোচিং করিয়েছেন ক্লাব এবং জাতীয় পর্যায়ে। সাত এবং আটের দশকে বিভিন্ন সময়ে কলকাতা ময়দানে দীর্ঘদিন কোচ ছিলেন দুই প্রধানের, কখনও ইস্টবেঙ্গলে, কখনও মোহনবাগানে। নিজের ছোট ভাই প্রসূন ব্যানার্জি থেকে শুরু করে গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরী, সুধীর কর্মকার, সাবির আলি, সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, বিদেশ বসু, মানস ভট্টাচার্য, হাবিব-আকবর, ভাস্কর গাঙ্গুলি, শিবাজী ব্যানার্জি, অলোক মুখার্জি, বাইচুং ভুটিয়ার মতো কত তারকা যে কোচ পিকে-র ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
ফুটবলার পিকে কখনও লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে চড়াননি, ক্লাব ফুটবল খেলেছেন শুধু ইস্টার্ন রেলওয়ের হয়েই। কিন্তু কোচ হিসেবে তাঁর ক্ষুরধার ফুটবল-মস্তিষ্ক অসংখ্য ট্রফি এনে দিয়েছে লাল-হলুদ আর সবুজ-মেরুনকে। ১৯৭২-এ তাঁর কোচিংয়ে একটিও গোল না খেয়ে কলকাতা লিগ জেতে ইস্টবেঙ্গল। স্বাধীনোত্তর কলকাতা ফুটবলে এই বিরল নজির সেই প্রথম।
সে বছরে শুধু লিগ নয়, আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স এবং বরদলৈ ট্রফিও ইস্টবেঙ্গলকে এনে দেন পিকে। এর ঠিক পাঁচ বছর পরে, ১৯৭৭-এ পিকে-রই কোচিংয়ে ত্রিমুকুট (আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্স) জিতে বিরল নজির স্থাপন করে মোহনবাগান। ১৯৭৫-এর যে ঐতিহাসিক শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ৫-০ হারিয়েছিল চিরশত্রু মোহনবাগানকে, কলকাতা ডার্বির ইতিহাসে স্মরণীয়তম সেই ম্যাচে লাল-হলুদ শিবিরের কোচ ছিলেন পিকে-ই।
ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করে তাঁদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পিকে-র বিখ্যাত 'ভোকাল টনিক'-এর কথা আজও তাঁর কোচিংয়ে খেলা তারকাদের মুখে মুখে ফেরে। ক্লাব ফুটবলে তাঁর সঙ্গে আরেক ধুরন্ধর কোচ অমল দত্তের টক্কর দশকের পর দশক ধরে মাতিয়ে রেখেছিল কলকাতা ফুটবলকে।
জাতীয় দলের কোচিংয়ের সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন পিকে। দেশের ফুটবল কোচের দায়িত্ব প্রথম পান ১৯৭২-এ। ভারতের কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ১৯৮৬ পর্যন্ত। চারটে এশিয়াডে ভারতের কোচ ছিলেন। ১৯৭০ -এ ব্যাঙ্কক, '৭৪-এ তেহরান, '৮২-তে দিল্লি এবং '৮৬-তে সিওলে। ১৯৭০-এর এশিয়াডে তাঁর প্রশিক্ষণেই ব্রোঞ্জ জেতে ভারত।
জামশেদপুরে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১-৯৭। ফের ভারতীয় ফুটবল দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেন ১৯৯৯-তে। দেশজ ফুটবলে কোচ হিসেবে যা যা জেতার ছিল পিকে-র, যা যা পাওয়ার ছিল, সবই সম্পূর্ণ তখন। কোচ হিসেবে ক্লাব এবং দেশের হয়ে ৫৪ টি ট্রফি জেতা হয়ে গেছে ততদিনে। যে রেকর্ডের ধারেকাছে কেউ নেই।
পিকে আর নেই। ভুল। আছেন, এবং থাকবেন ভারতের ফুটবল ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন নিয়ে। আছেন, এবং থাকবেন অগণিত ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়জুড়ে।
জীবনানন্দ লিখেছিলেন, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কথাটা শুধু কবি বা কবিতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। ভারতীয় ফুটবলেও দিব্যি ব্যবহার্য। সামান্য পাল্টে নিতে হবে শুধু।
সকলেই পিকে নন, একজনই পিকে।