কোচ প্রদীপ ব্যানার্জির 'ভোকাল টনিক' সত্তর এবং আশির দশকে কলকাতা ময়দানে ছিল কিংবদন্তিসম। পিকে ছিলেন বাগ্মী মানুষ, দারুণ কথা বলতে পারতেন। ফুটবল ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ ছিল, পড়াশুনাও ছিল বিস্তর। সেই বাগ্মীতাকে নিজের দুর্দান্ত সফল কোচিং জীবনে পিকে নিপুণ কৌশলে কাজে লাগিয়েছিলেন 'ভোকাল টনিক'-এর মোড়কে। যা তাতিয়ে দিত ফুটবলারদের, প্লেয়ারদের থেকে তাঁদের সেরাটা বার করে আনত অনায়াসে।
সাতের দশকের শুরু থেকে নয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পিকে-র সাফল্য-ঝলমল কোচিং-কেরিয়ারে অজস্র গল্প ছড়িয়ে আছে এই বিখ্যাত 'ভোকাল টনিক'-এর, যা আজও সে সময়ের তারকা ফুটবলারদের মুখে মুখে ফেরে। ম্যাচ শুরুর আগে ড্রেসিংরুমে গমগম করত পিকে-র আবেগদীপ্ত কন্ঠস্বর। কখনও বলতেন, "জার্সি তোমাদের মা! জার্সির অসম্মান মানে মায়ের অসম্মান। তোমাদের মাকে কেউ অসম্মান করলে তার উপর যেভাবে ঝাঁপাবে, সেভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ো প্রতিপক্ষের উপর।"
কখনও আবার তুলে আনতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের নানা অজানা বীরত্বের কাহিনি, কখনও উঠে আসত বাংলার অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের কথা। "শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকতে ম্যাচ হারব না আমরা," পিকে-র হুঙ্কারে টগবগিয়ে ফুটতেন প্লেয়াররা।
আরও পড়ুন: তিন দশকের ব্যবধান পেরিয়ে শুনছি পিকে’র কণ্ঠস্বর, ‘ফাইট বেঙ্গল, ফাইট!’
শুধু কী ফুটবল, তিরিশ বছর আগে, ১৯৯০-তে বাংলা ক্রিকেট দলের শেষ রঞ্জিজয়ের নেপথ্যেও অবদান ছিল পিকে-র ভোকাল টনিকের। কীর্তি আজাদ-রমন লাম্বা-মনিন্দর সিং-এর মতো তারকাদের নিয়ে গড়া প্রবল পরাক্রমী দিল্লির বিরুদ্ধে সেবার ইডেনে ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলা। ম্যাচের আগের দিন সন্ধেয় বাংলার ক্যাপ্টেন সম্বরণ ব্যানার্জির অনুরোধে পিকে এসেছিলেন ইডেনে। বাংলার ড্রেসিংরুমে কাটিয়েছিলেন এক ঘন্টা।
পিকে-র ভোকাল টনিক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন অরুণ লাল, অশোক মালহোত্রা, উৎপল চ্যাটার্জি, শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়রা। সেই ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং-করা শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে, "প্রদীপদা সেদিন অনেকক্ষণ একটানা বলেছিলেন। অতীতের বহু রেফারেন্স টেনে এনেছিলেন। বলেছিলেন, বাউন্ডারির দড়ি পেরিয়ে একবার মাঠে পা রাখলে আর ভাববে না, বিপক্ষে কে আছে। শুধু নিজেরা নিজেদের বলবে, 'আই ক্যান ডু ইট, ইউ ক্যান ডু ইট, উই শ্যাল ডু ইট! ফাইট বেঙ্গল ফাইট!' প্রদীপদার কথায় চেগে গিয়েছিল গোটা টিম।"
বাকিটা ইতিহাস। দিল্লিকে রানরেটের হিসেবে হারিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের রাজমুকুট সেবার উঠেছিল বাংলার মাথায়। যার নেপথ্যে কিছুটা অবদান রয়েই গিয়েছিল প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোকাল টনিকের।