রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ, ঢাকা
বাংলাদেশ জেতার কারণেই প্রথম ওয়ানডেতে ৪ উইকেটের জয় নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না। আর এখানেই একটু হলেও ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন আফিফ হোসেন এবং মেহেদি হাসান মিরাজ। তাঁরা যে অবিশ্বাস্য জুটি উপহার দিয়েছেন তার মাহাত্ম্যও খানিকটা কমছে। দলটার নাম আফগানিস্তান না হলে ভারত-অস্ট্রেলিয়া হলে এতক্ষণে মহাতারকায় পরিণত হতেন আফিফ-মিরাজ। কিন্তু আপনি যদি মাঠে কিংবা টিভি সেটের সামনে ম্যাচটি দেখে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন এই ম্যাচে কী করেছেন এই দুই তরুণ! মুখে না বললেও এই আফগানদের নিয়ে বাংলাদেশ দলের মনে ভয় আছে! সেটা তাদের ওই বিশ্বমানের বোলিং আক্রমণের কারণেই। রশিদ খান-মুজিব-উর-রহমানরা মনে হয় সেকালের মুত্তিয়া মুরালিধরণ-সাকলাইন মুশতাক হয়ে উঠেছেন!
বাংলাদেশের ভাবনাতেও ছিল রশিদ-মুজিব। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড বাংলাদেশের টপ অর্ডারের ছয় ব্যাটসম্যানকে নাচালেন ২১ বছরের এক আফগান তরুণ! নাম তার ফজল হক ফারুকি। ৫ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোরবার্ডে উঠল ১৮ রান। ততক্ষণে আসল সর্বনাশটা করে ফেলেছেন সেই ফজল হক ফারুকি। বাংলাদেশ দল যে ৪ উইকেট হারিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।আউট হয়ে গিয়েছেন লিটন দাস (১), তামিম ইকবাল (৮), মুশফিকুর রহিম (৩) এবং ইয়াসির আলী শূন্য রানে। এই ৪টি উইকেটই নিয়েছেন ফজলহক ফারুকি। এক সময় তার বোলিং ফিগার দেখাচ্ছিল এমন ৩-১-৯৪! স্রেফ অবিশ্বাস্য!
তখনও বাংলাদেশের পায়ের তলায় মাটি শক্ত ছিল সাকিব আল হাসান উইকেটে ছিলেন বলে। সদ্য শেষ হওয়া বিপিএলে টানা পাঁচ ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা সাকিবও(১০) ভরসা দিতে পারলেন না। বোল্ড হয়ে গেলেন তারই বরিশাল সতীর্থ মুজিব-উর-রহমানের বলে। বহু বিপদে যিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন সেই মাহমুদউল্লাহকেও(৮) পাশে পেল না বাংলাদেশ। ৪৫ রানের মধ্যে এক থেকে ছয় শীর্ষ ব্যাটসম্যানকে হারালে তখন ২১৫ রানকেও সাড়ে তিনশ মনে হওয়াটা অমূলক নয়!
আরও পড়ুন: নিলামে সাকিবকে কেন ডাকল না আইপিএলের দশ ফ্র্যাঞ্চাইজি, আসল কারণ জেনে নিন
কিন্তু এদিন যে সাতে নামে আফিফ হোসেন এবং আটে নামা মেহেদি হাসান মিরাজ ধনুরভাঙা পণ করেই যুগলবন্দীর ইতিহাস রচনা করবেন সেটা কেই বা ভেবেছিলেন। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে আর উইকেট দেবেন না! শেষ অবধি হলও তাই।
আফিফ-মিরাজ সপ্তম উইকেটে ১৭৪ রানের অবিশ্বাস্য এক জুটি গড়ে বাংলাদেশকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন।
ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচেই ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন মিরাজ। এর পরের গল্প শুধুই হতাশার। মাঝের ৩১ইনিংসে কোনও ফিফটির দেখা নেই। আর মিরাজ যে পজিশনে ব্যাট হাতে নামেন সেখানে খুব বেশি কিছু করার সুযোগও থাকে না। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে এল মিরাজের ব্যাটিং সত্ত্বা। ১২০ বলে ৯ চারের সাহায্যে ৮১ রানে অপরাজিত থাকলেন। আফিফ অষ্টম ম্যাচেই নজরকাড়া এক ইনিংস উপহার দিলেন। যেটা বহুদিন সবার মনে থাকবে। ১১৫ বলে ১১ চার আর এক ছক্কায় আফিফের ব্যাট থেকে এসেছে অপরাজিত ৯৩।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশংসার বানে ভাসছেন আফিফ-মিরাজ।
কিন্তু বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম যেমনটা আশা করেছিলেন আফিফের মধ্যে তেমনটা দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন, "ওঁর (আফিফ হোসেন) কাছে যেরকম ধারাবাহিকতা আশা করেছিলাম তেমনটা দেখিনি। আজকে (২৩ ফেব্রুয়ারী) খুবই ভালো একটা ইনিংস ছিল এবং আজকের ইনিংসটি প্রমাণ করে ওর ওই ধরণের খেলার যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু যে মানের ক্রিকেটার হিসাবে আমি ওকে ভাবি এবং সেই মানের খেলোয়াড়ের জন্য যে ধারাবাহিকতা দরকার সেটা ও দেখাতে পারেনি। এটার দায়টা কিন্তু ওর নিজেরই। ও চাইলেই এ ধরণের ইনিংস খেলতে পারে। তার প্রমাণ তো এদিনই দিল।"
"সম্প্রতি বিপিএলে কিছু কিছু ইনিংস খেলেছে ভালো।সবমিলিয়ে যদি বলি আফিফ ওর মান অনুযায়ী খেলতে পারেনি। ওর ভিতরে যোগ্যতা থাকাটা এক জিনিস সেটাকে বাইরে নিয়ে আসাটা আরেক জিনিস। সেটাকে ধারাবাহিকভাবে নিয়ে আসার জন্য যে ধরণের প্যাশন দরকার, যে ধরণের ক্ষুধাটা দরকার, সেই ক্ষুধাটার কোথাও না কোথাও অভাব আছে। না হলে যতদিন হলো ও ক্রিকেট খেলছে এতদিনে বাংলাদেশের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে যেত। ও যদি ধারাবাহিক হতে চায় তাহলে ওকে ওই ক্ষুধাটা দেখাতে হবে, যে ভীষণরকমের রান করতে চায়, অনেক রান করতে চায়। ও যখন ব্যাট করছিল প্রায়ই মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি ওভার দ্য টপে বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে গেল! এরকম প্রায়ই মনে হচ্ছিল। কারণ এই জিনিসটা ওর ইনিংসে অনেকবার দেখেছি।”
ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে যেভাবে মিরাজকে সঙ্গী করে বাংলাদেশকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন তার জন্য বড়সড় ধন্যবাদ প্রাপ্য আফিফের। চারদিক থেকে সেই ধন্যবাদ পাচ্ছেনও। আর পাবেই না বা কেন আফিফ-মিরাজের আগে যে আর একবারই সপ্তম উইকেটে সবচেয়ে বেশি রান উঠেছে। ২০১৫ সালের জুনে বার্মিংহামে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে জস বাটলার ও আদিল রশিদ সপ্তম উইকেটে ১৭৭ রান তুলেছিলেন। সেটা ছিল প্রথম ইনিংসে। তাঁদের ৪৫ রানের মধ্যে ৬ উইকেট কিংবা জয়ের জন্য চিন্তাও করতে হয়নি। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিল আফিফ-মিরাজের জুটি। চাপকে জয় করে বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছেন তাঁরা।
নাজমুল আবেদীন বলে চলেন, “আগের ইনিংসগুলোর মতো আজ হয়নি। এত ভালো বোলিংয়ের বিপক্ষেও সেই ভুল হয়নি। এতেই বোঝা যায় ওর ভেতরে জিনিসটা আছে। এটা বারবার মাঠে দেখানোটা জরুরি এবং ওর কাজই কিন্তু এটা। আমরা যদি বলি ও অনেক বেশি করে ফেলেছে আসলে তা না, ওর কাজই এটা। ও যাবে খেলবে, টিমকে জেতাবে এটাই ওর কাজ।”
পাঁচ নম্বর পজিসনে কে ব্যাটিং করবেন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচের আগেও এ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। সেখানে ইয়াসির আলী এবং মাহমুদুল হাসান জয়ের কথা এসেছে। ইয়াসিরের তো অভিষেকই হলো। তবে অভিষেকটা সুখকর হয়নি ইয়াসিরের। যে ইনিংস খেলেছেন আফিফ তাতে পাঁচ নম্বরের জন্য তিনি প্রমোশন দাবি করতেই পারেন।
নাজমুল আবেদীন ফাহিম আরও বলে গেলেন, “রাব্বি (ইয়াসির আলি) যে খারাপ খেলে, এমন তো নয়। রাব্বিও ভালো খেলে। এখন আজকে হয়তো ওর ইনিংসটা দেখে বলতে চাই আফিফকে আরও উপরে খেলানো উচিৎ। ও যখন ধারাবাহিকভাবে এরকম খেলবে তখন যেটা হবে উপর থেকেই কাউকে সরে যেতে হবে ওকে জায়গা দেয়ার জন্য। উপরে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আছে যাদের রিটায়ারমেন্টের সময় চলে এসেছে। নিচে থেকে এ ধরণের খেলোয়াড়েরা যখন ভালো করা শুরু করবে। এরাই কিন্তু ওদেরকে রিপ্লেস করবে।”
আফিফের বহু আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চৌহদ্দিতে পা পড়ে মিরাজের। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে তার আলো ঝলমলে শুরু।বল হাতে ধারাবাহিক মিরাজ যেন তার ব্যাটিং সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলেছেন। অথচ অনূর্র্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক থাকার সময় তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। মিরাজেরও যে একটা ব্যাটিংয়ের মন আছে সেটা নাজমুল আবেদীন ফাহিম ভালো করেই জানেন।
তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-র কাছে ব্যাখ্যা করছিলেন, “মিরাজকে আমরা বোলার হিসাবে দেখি। কিন্তু ওর মধ্যে একটা ব্যাটিং সেন্স আছে, ব্যাটসম্যানের মতো চিন্তা করতে পারে। পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যানের মতো স্কিল আছে, সেটা বলব না তবে ব্যাটিং স্কিল আছে। ব্যাটসম্যানের মতো মন আছে, মাইন্ডটা ওর ব্যাটসম্যানের মতো। ব্যাটসম্যানের মতো চিন্তা করতে পারে, প্ল্যান করতে পারে এবং আস্তে আস্তে ওর ব্যাপারটা শার্প হচ্ছে। দুই বছর আগেও এভাবে সে ব্যাটিং করত না, ব্যাটিংটাকে অত গুরুত্ব দিত না। কারণ অন্যরা ওর ব্যাটিংটাকে তেমন গুরুত্ব দিত না। ও নিজেকে তখন বোলার হিসাবে ভাবা শুরু করল। কিন্তু অনূর্ধ-১৯ দলে থাকার সময় ওর ভিতর ভালো ব্যাটসম্যান ছিল। আমার মনে হয় ও ওই জায়গাটায় আস্তে আস্তে যাচ্ছে। বিপিএলেও আমরা ওকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলতে দেখেছি। আজকের ইনিংসটি ওকে অনেক ব্যাপারেই ফিডব্যাক দেবে। ও ব্যাটসম্যান হিসাবে দলে অবদান রাখার যোগ্যতা রাখে সেই জিনিসটা ওকে আবার মনে করিয়ে দেবে।”