মিঠুন ভৌমিক
ভারতে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে এই মহাদেশোপম ভূখণ্ড স্রেফ জোর খাটিয়ে শাসন করা যাবে না, বিশেষ করে উদ্দেশ্য যখন শুধু শাসন নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ফায়দা তোলা। সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন উপমহাদেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের সমর্থন থাকবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি। এই সময় এক চমৎকার আঁতাত তৈরি হয়। ঠিক হয়, অভিজাত পরিবারগুলি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি প্রশ্নাতীতভাবে অনুগত থাকবে। তার বিনিময়ে সেইসব পরিবারের ছেলেরা পাবে 'ব্রিটিশ জেন্টলম্যান' হয়ে ওঠার সুযোগ।
এই খাঁটি সায়েব হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি ছকে দেন লর্ড কার্জন, উনিশ শতকের শেষের দিকে। সেই তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীকে ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সত্যবাদিতা, ইত্যাদির অনুশীলনের সাথে সাথে 'পুরুষোচিত খেলাধুলোয়' অংশ নিতে হবে। প্রায় ১৯০০ সাল পর্যন্ত অভিজাত সম্প্রদায় এই খোয়াবে মশগুল থাকে। তারা ইংলিশ পাবলিক স্কুলের মডেলে তৈরি স্কুলে পড়াশুনো করতো, এবং সেই স্কুলগুলো থেকেই তারা ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ক্রীড়াপ্রেম 'আয়ত্ত' করে।
ব্রিটিশ আমলারা জানতেন খেলাধুলোর মাধ্যমে খুব দ্রুত সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়তে পারে। আর ফুটবল বা ক্রিকেটের মত দলগত খেলায় একসাথে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায় সেটাও ততদিনে স্পষ্ট হচ্ছিল। ইতিমধ্যে পৃথিবী জুড়ে ফুটবল ছড়িয়ে পড়ছে ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। শুধু ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি ধরলেই দেখা যাবে কীভাবে অস্ট্রেলিয়া থেকে আফ্রিকা সর্বত্র ফুটবল জনসাধারণের খেলা হয়ে উঠেছে ক্রমশ।
আরও পড়ুন: ফুটবলায়নের দিনগুলি - পৃথিবীজোড়া ফুটবল চর্চার ইতিহাস
সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে দেখে নেওয়া যাক সরকার ফুটবলের বিকাশে কতটা মরিয়া ছিলো। কাশ্মীরের প্রবাদপ্রতিম মিশনারি ও হেডমাস্টার টিন্ডাল বিসকোকে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলেদের ফুটবল শেখানোর। পরিকল্পনামাফিক একদল স্কুলশিক্ষক স্বয়ং হেডস্যারের তত্ত্বাবধানে সেইসব ছাত্রদের ডেকে এনে ফুটবল শেখাতে গেলে ভয়ানক গোলমাল শুরু হয়। ছাত্ররা চামড়ার বল 'অপবিত্র ও নোংরা' বলে তাতে পা ঠেকাতে রাজি হয় না। শেষে বেত নিয়ে স্যারেরা ছাত্রদের ঘিরে ধরে দাঁড়ান, কয়েক মিনিটের স্তব্ধ অপেক্ষার পর ফুটবল প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
একদিকে ইংলিশ পাবলিক স্কুলের কড়া নজর, অন্যদিকে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক চাপ। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লর্ড ম্যাকলে কটাক্ষ করে লেখেন, "বাঙালীরা শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল (তুলনা করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন 'মেয়েদেরও অধম' বলে), তারা চিরকাল অন্য সম্প্রদায়ের শক্তপোক্ত লোকেদের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়।"
এই স্টিরিওটাইপিং ভাঙতে একদল জাতীয়তাবাদী নেতা ১৮৬০ সাল থেকেই স্থানীয় মানুষদের মধ্যে শারীরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার উদ্যোগ নেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রভাব, বা দেশজ আত্মাভিমান, যেকোন কারণেই হোক, ধীরে ধীরে খেলাধুলো, বিশেষ করে ফুটবল ও ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ে। এর ফলশ্রুতিই কলকাতা জুড়ে একের পর এক ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিযোগিতামূলক ক্লাব ফুটবলের সূচনা, যা আমরা আগের পর্বে দেখেছি। ১৯১১ সালের মোহনবাগানের শিল্ড জয় দেখতে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, এমনকি আসাম থেকেও মানুষ কলকাতায় এসেছিলেন। এর জন্য স্পেশাল ট্রেন, স্টিমার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়। গোল্ডব্লাট প্রমুখ ক্রীড়া ঐতিহাসিকরা বলেছেন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে যে চাপা ক্ষোভ বাংলার মানুষ পুষে রেখেছিলেন, তা ১৯১১ সালের শিল্ড ফাইনালে মাঠে ও মাঠের বাইরে প্রকাশ পায়।
FIFA World Cup 2018: কলকাতায় বিশ্বকাপের কাউন্টডাউন, থাকল লেভ ইয়াসিন থেকে জাবিভাকা
পৃথিবীর ফুটবল মানচিত্রেও উনিশ শতক খুবই ঘটনাবহুল। ১৮৭০ নাগাদ ফুটবল পৌঁছয় অস্ট্রেলিয়ায়, একইভাবে ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে। ভারতের মত অস্ট্রেলিয়াতেও জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ দানা বাঁধতে থাকে প্রতিযোগিতামূলক দলগত খেলাধুলোয়। ১৮৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল শাসক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়া এই পর্বের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এখানেও আমরা দেখতে পাই শাসকের বিরুদ্ধে প্র্রতিবাদের, ক্ষোভ প্রকাশের বা তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছে প্রকাশ পাচ্ছে খেলার মাঠে। বিশেষ করে ফুটবলের মত খেলায়, যেখানে শারীরিক শক্তি ও ক্রীড়ানৈপুণ্য দুয়েরই প্রয়োজন, সেখানে তা প্রতিবাদীকে অপূর্ব সুযোগ দেয় লড়াই করার। যদিও সে লড়াই খুবই অসম। যাই হোক, অস্ট্রেলিয়ায় ফুটবলের প্রসার কিছুদিন থমকে যায় মূলত ক্রিকেট, রাগবির প্রাধান্যে। ফলে একটি সক্রিয় ফুটবল সংস্থা তৈরি হতে লেগে যায় বহু বছর। একইভাবে নিউজিল্যান্ডেও ফুটবলের শুরুর দিনগুলো শ্লথ, প্রায়শই দুর্বল পরিচালনার শিকার।
ভারতের ফুটবল ইতিহাসের শুরুর দিনগুলিতে যেকোন দেশজ ক্লাবকে অকথ্য অবিচার ও জঘন্য পক্ষপাতের শিকার হতে হয়েছে। মোহনবাগান ১৯১১ সালে শিল্ড জেতার পরে কলকাতার ক্লাবগুলিকে লিগে পরের বছরগুলোয় এই অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ১৯১২ সালের শিল্ড ফাইনালের কথা, যেখানে অফসাইডের অজুহাতে মোহনবাগানের দুটো গোল বাতিল হয়। এই শাসক ও শাসিতের দ্বন্দ্ব এরপর ক্রমশই বেড়ে উঠতে থাকে। স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে খেলার মাঠের প্রতিযোগিতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই, ১৯৩০ সাল থেকে, বাংলার স্থানীয় ফুটবলমহল বিদ্রোহ ঘোষণা করে আলাদা সংস্থা তৈরি করে। এর পরেই ময়দানে আবির্ভাব হয় দুটি নতুন শক্তির - ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডান স্পোর্টিং। ইস্টবেঙ্গল ১৯৪৩ সালে শিল্ড এবং '৪৫-এ লিগ শিল্ড দুইই জেতে। অন্যদিকে মহমেডান স্পোর্টিং ১৯৩৪-৩৮ একটানা কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ১৯৪০ সালে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ডুরান্ড কাপ জিতে নেয়। মহমেডান স্পোর্টিং-এর উত্থান এবং প্রথম সুযোগেই প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে কলকাতা লিগ জেতা এই সময়ের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ভারতীয় ফুটবলের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ক্রমশই বোঝা যাচ্ছিল, খেলার মাঠের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে স্থানীয় ক্লাবগুলো নিয়ে নিচ্ছে।