ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সাঁতরাগাছি হয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ছড়িয়ে ধুলাগড়। সেখান থেকে ডান দিকের টার্ন ধরে কিমি পাঁচেক গেলেই দেউলপুর। হাওড়া জেলার প্রাচীন জনপদ। 'গ্রাম' বলা হলেও কালের নিয়ম মেনে আপাতত সেই জনপদের গায়ে মফঃস্বলের ছাপ পড়ে গিয়েছে বহুদিন। তবে এখনও গ্রামের নাভি চিরে রয়ে গিয়েছে বেশ কিছু সুপ্রাচীন মন্দির। সেই মন্দির বা দেউল থেকেই নাম দেউলপুর। এমনটাই কথিত রয়েছে।
মন্দিরের মতই গ্রামের শ্বাস প্রশ্বাস থেকে আপাতত হারিয়ে যেতে বসেছে পোলো বলের ঐতিহ্য। পোলো বলকে কেন্দ্র করেই বিশ্বে আলাদা সম্মানের সিংহাসন আদায় করে নিয়েছিল দেউলপুর। সেই পরম্পরা হারিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক দশক।
টলটলে পুকুর, গোলা ভরা ধান, ছায়াপদ, সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠ প্রান্তর, চাষবাস- গ্রামের সমস্ত নিয়ম মেনেই দেউলপুরেরও অলঙ্কার এসব। তবে সেই অলঙ্কারের মধ্যেই হিরের মর্যাদা বাঁশকে কেন্দ্র করে। উত্তর পশ্চিমে বাগ পাড়া। সেই পাড়া ঘিরে বাঁশ গাছের দীর্ঘ ছায়া। সেই বাঁশকে কেন্দ্র করেই নতুন স্বপ্ন দেখেছিল গ্রামবাসীরা।
বহু যুগ আগের কথা। তখন ইংরেজ আমল। সেই সময় বাঙালিরা চাকরি বাগাত দু-এক চলনসই ইংরেজি শব্দ শিখে, কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। দেউলপুরের নাতিদীর্ঘ ইতিহাস ঘাটলে শোনা যায়, সেই সময় গ্রামেরই এক ভদ্রলোক কলকাতায় নামি ব্রিটিশ ফার্মে চাকরি পেয়েছিলেন। এখনকার মত তখন যাতায়াত এত সুলভ ছিল না। কলকাতাতেই।থাকতেন তিনি। সপ্তাহান্তে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতেন।
ব্রিটিশদের মোসায়েবি করা সেই ব্যক্তির বাল্যবন্ধু ছিলেন বিপিনবিহারি বাগ। দেউলপুরে এসে তিনি গ্রামের মানুষের কাছে গল্প করতেন কলকাতার আদব কায়দা, চাল চলন। সকলে মুগ্ধ হয়ে গোগ্রাসে গিলত তাঁর গল্প। এমনই একবার গল্পছলে সেই ব্যক্তি বন্ধু বিপিনবিহারিকে বলেছিলেন, সায়েবদের পোলো খেলার কাহিনী। সেই সময় সাহেবরা কাঠের বলে।ঘোড়ায় চড়ে পোলো খেলতেন গড়ের মাঠে।
তবে কাঠের বল হওয়ায় সেই বলের গতি স্বাভাবিক ছিল না। বারবার মন্থর গতির কারণে খেলা বাধাপ্রাপ্ত হত। বিপিনবিহারিকে সেই ভদ্রলোক সেই কথা বলতেই যেন আচমকা মাথায় নতুন বুদ্ধি খেলে যায়। ঝাড়ের বাঁশ কাটার পরে বাঁশের শিকড় সমেত গোড়া অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। সেটা দিয়েই পোলো বল তৈরির ভাবনা মাথায় এল বিপিনবিহারীর।
পরের সপ্তাহেই বিপিনের বন্ধু কলকাতা থেকে এনে দিলেন কাঠের পোলো বল। সেই আকৃতি দেখে অবিকল বাঁশের গোড়া কেটে বিপিনবিহারি বানিয়ে দিলেন পোলো বল।
আর সেই বল ইংরেজদের কাছে পৌঁছতেই কেল্লাফতে। ইংরেজদের মহাখুশির খবর বন্ধুর কাছে এনে দিলেন সেই ব্যক্তি। তারপরে বিপিনের চাষবাস মাথায় উঠল। বানিয়ে ফেলতে লাগলেন একের পর এক পোলো বল। সেই পোলো বল এতটাই উচ্চমানের হল যে কলকাতা থেকে একের পর এক অর্ডার আসতে থাকল। কলকাতায় ধর্মতলা স্ট্রিটে পোলো বল বিক্রির জন্য নতুন দোকানই চালু হয়ে গেল।
জানা যায়, সেই দোকানে বছরে কয়েক লক্ষ বল সরবরাহ করতেন বিপিন। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় দোকান ছেড়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে উদ্যোগী হন মালিক। সেসময় বিপিনকে সেই দোকান কেনার প্রস্তাব দেন সায়েব। দাম হাঁকা হয় ৫৫০ টাকা। তবে কেনেননি বিপিনবিহারি।
কীভাবে বানানো হত এই পোলো বল? দেউলপুড়ে ওয়াকিবহাল বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বাঁশের গোড়াকে চলতি ভাষায় বলা হয় জর। সেই জর লম্বাভাবে কাটতে হবে প্রথমে। তারপরে নিখুঁত মাপের গোলগোল করে আকৃতি দিতে হবে। গোল হওয়ার পরে শিরীষ কাগজ ঘষে ঘষে মসৃন করতে হয়। এরপরে পাউডার এবং শিরীষ আঠা দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে বলের গায়ে মোলায়েমভাবে মাখাতে হবে। এরপরে সেই মসৃন আচ্ছাদনের গায়ে এনামেল অথবা তেল রং করে শুকোলেই তৈরি পোলো বল।
বিপিনবিহারীর হাত ধরে যে দুরন্ত সম্ভবনার সূচনা হয়েছিল তা আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে তাঁর দুই পুত্র সতীশচন্দ্র এবং যুগলকৃষ্ণ বাগের হাত ধরে। সরাসরি সেই সময় বিলেতে বল রফতানি করা হত দেউলপুর থেকে।
সেই বাগ পাড়া হয়ে ওঠে বিশ্বের কাছে পোলো বল তৈরির একমাত্র কারখানা। কয়েকশো বাসিন্দা রাতভর কাজ করতেন। তাতেও পুরোপুরি যোগান কুলিয়ে ওঠা যেত না।
তবে এখন এই বাঁশের পোলো বল বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বাঁশের জায়গায় বর্তমানে পোলো বল তৈরি হয় প্লাস্টিক দিয়ে। সেই বলের রমরমা চালুর পরে দেউলপুরের পোলো বল ঐতিহ্যও মুখ থুবড়ে পড়ে। ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে গ্রাম্য বাঙালির নিজের হাতে গড়া ইতিহাস।
কজন বাঙালিই বা এই ইতিহাস জানেন!