/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/07/ms-dhoni-m2.jpg)
মহেন্দ্র সিং ধোনি (এক্সপ্রেস ফটো)
ফেব্রুয়ারি ২০০৮, কমনওয়েলথ ব্যাঙ্ক সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার ১৬০ রান তাড়া করতে নেমেছিল ভারত। মেলবোর্নে সেদিন ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিজের ১৫ নম্বর ম্যাচে নেমেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। রোহিত শর্মার সঙ্গে ক্রিজে ছিলেন তিনি। ভারতের জেতার জন্য যখন ১০ রান প্রয়োজন তখন ধোনি গ্লাভস বদলের জন্য ড্রেসিংরুমের দিকে ইশারা করেন। সে অর্থে কোনও প্রয়োজন ছিল না তখন। ক্রিকেটে সাধারণত ড্রেসিংরুম থেকে কোনও বার্তা এলে গ্লাভস পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনাটা উল্টোই ঘটল। ধোনি বার্তা পাঠালেন দলের কাছে। সাফ জানিয়ে দিলেন, “ম্যাচটা জেতার পর কেউ যেন ব্যালকনিতে সেলিব্রেট না-করে।’’
এরই মাঝে ধোনি আবার রোহিতকে বলে দিলেন যে, ম্যাচের পর কীভাবে করমর্দন করতে হবে অজি ক্রিকেটারদের সঙ্গে। সেই সফরের একজন ক্রিকেটার বলছেন, “ধোনি বলেছিল যখন ওরা হাত বাড়িয়ে দেবে তখন যেন আমরা এমন ভাবে হ্যান্ডশেক না-করি যাতে বোঝা যায় যে, আমরা কৃতজ্ঞ। বরং আমরা শক্ত করে একবারই হাতটা ধরব ভীষণ শীতল ভাবে, ওদের চোখে চোখ রাখব, বার বার শেক করব না। যেন জয়ের উত্তেজনা প্রকাশ না-পায়।’’ দলের তরুণ ক্রিকেটারদের এভাবেই শিক্ষিত করেছিলেন ধোনি।
এটা সেসময়ের কথা যখন অস্ট্রেলিয়া নিজেদের সেই অপ্রতিরোধ্য মেজাজ ধরে রেখেছে। তাদের হারাতে পারা যে কোনও দলের কাছে বিশাল ব্যাপার। সে ম্যাচে শুরু থেকেই আধিপত্য বজায় রেখেছিল টিম ইন্ডিয়া। ইশান্ত শর্মা, শ্রীসান্থ ও ইরফান পাঠানরা ন’উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ১৫৯ রানে বেঁধে দিয়েছিল। আর ধোনি এভাবেই বিপক্ষের কাছে শীতল ঔদ্ধত্যের বার্তা দিয়েছিলেন। ওই ক্রিকেটার আরও জানান, “ ধোনি বলেছিলেন, ১৬০ রান তাড়া করে জেতাটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু আমরা যদি আনন্দে গা ভাসিয়ে দিই, তাহলে অস্ট্রেলিয়া বুঝেই যাবে যে এটা অঘটন। কিন্তু আমরা বলতে চেয়েছিলাম, জয়টা ফ্লুকে আসেনি। এরপর থেকে এটাই বারবার হতে চলেছে। অস্ট্রেলিয়া এটাই মেনে নিতে পারেনি। ওরা নড়ে গিয়েছিল।” সেটাই প্রথম ভারতের কমনওয়েলথ সিরিজ জয়।
সেই সিরিজে ভারতীয় দলের এক তরুণ ক্রিকেটার ধোনির কাছে এসে, অস্ট্রেলিয়ার এক প্রথম সারির ব্যাটসম্যানের সম্বন্ধে অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেই অজি ব্যাটসম্যান বিপক্ষের সব ব্যাটসম্যানকেই মারাত্মক স্লেজ করে চাপে রাখে। যখন ভারতীয় এক ক্রিকেটার স্লেজের পাল্টা দেন, তখন আরেক অজি ক্রিকেটার এসে সেই ভারতীয় ক্রিকেটারকে এসে বলেন, সম্মান করতে শেখ। পরেরবার যখন সেই তারকা অজি ব্যাটসম্যান ওপেন করতে নামেন, তখন ধোনি বাউন্ডারি লাইনের কাছে সব জুনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে লাইন করে দাঁড়ান। দেখলে মনে হবে যেন গার্ড অফ অনার। এরপর ধোনি মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলেন আর মুখে বলতে লাগলেন, “রেসপেক্ট...রেসপেক্ট...রেসপেক্ট’’ । প্রাক্তন এক সতীর্থ বলছেন “ মাহি এভাবেই ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিল। ইয়ে লে লো রেসপেক্ট (তোমরা সম্মান চেয়েছিল, এই নাও সম্মান)।’’
এই কমনওয়েলথ ব্যাঙ্ক সিরিজের আগেই ঘটে গিয়েছিল বিখ্যাত ‘মাঙ্কিগেট’ কাণ্ড। সিডনি টেস্টে স্টিভ বাকনারের কয়েকটা সিদ্ধান্ত যায় ভারতের বিপক্ষে। সেসময় ভারতের টেস্ট ক্যাপ্টেন অনিল কুম্বলে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, “একমাত্র একটা দলই ক্রিকেটের স্পিরিট বজায় রেখে খেলেছে।’’ সিডনির পরের ম্যাচ ছিল পার্থে। ভারত জিতে যায়। কিন্তু পন্টিং অ্যান্ড কোং সিরিজ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। ওয়ান ডে সিরিজেও পন্টিংরা এরকম আক্রমণাত্মক মেজাজেই ভারতকে বিঁধতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধোনির স্ট্র্যাটেজি আর দল পরিচালনায় দিশেহারা হয়ে যান তাঁরা। ভাবলে অবাক হতে হবে, এই কমনওয়েলথ সিরিজই ছিল ধোনির ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রথম বিদেশ সফর। টেস্টের কোনও উত্তাপ তিনি ওয়ান-ডে সিরিজে আসতে দেননি। শুধু কোনও প্রতিক্রিয়া না-দিয়েই সব কাজটা করে ফেলেছিলেন। এটাই ছিল ধোনির রক্ত না ঝরিয়েও যুদ্ধ জেতার মন্ত্র। কথা বলবে তাঁর ট্রফি। ধোনির এক কাছের বন্ধু বলছেন, “ধোনি গুলি করে নিজের স্টাইলে। ও কখনওই অতিরিক্ত আগ্রাসনে বিশ্বাস করে না। মা-বোন নিয়ে গালি দিতে দেয় না ও। ধোনি বিশ্বাস করে তুমি যদি কাউকে আঘাত করতে চাও, তাহলে নিজের মতো করে কর। ওদের দেখানো রাস্তায় নয়।’’
তারপরের সাত বছরে ও দু’টো সফরের পরেও ধোনি বদলাননি। ২০১৪-১৫ টেস্ট সিরিজের ঘটনা। সেবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বিরাট কোহলি, ডেভিড ওয়ার্নার ও ব্র্যাড হ্যাডিনরা রীতিমতো বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তবুও ধোনি বলেছিলেন যে, তিনি কখনও সমর্থন করেন না যে, তাঁর খেলোয়াড়রা বিবাদে জড়িয়ে পড়ুক। উল্টে চূড়ান্ত দুশ্চিন্তার মুহূর্তেও তিনি শান্ত করতে জানেন খেলোয়াড়দের। ২০১৩-র আইপিএল ফাইনালের কথাই ধরা যাক। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের আগুনে পুড়ছে আইপিএল। প্রায় প্রতিদিনই কারোর নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। টিমের প্রধান জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন। কখনও ক্রিকেটারদের হোটেল রুমে আটকে রাখা হচ্ছে। এরকম একটা মুহূর্তে দলের সতীর্থদের অনুপ্রাণিত করতে ধোনি এসে বলেন, “ বয়েজ, আমর আইপিএল ফেয়ার প্লে পুরস্কারের তালিকায় দু’নম্বরে আছি। আমরা সবকিছু করে প্রথমে আসতে চাই। তার জন্য সবাইকে গুড লাক।” এভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেন মাহি। একগুঁয়ে অধিনায়ক ও অসম্ভব মনের জোর সম্পন্ন অধিনায়কের একটা সূক্ষ্ম ফারাক থাকে। ধোনি এসব কিছু নিয়ে কাটাকুটি খেলেছেন।
ভিবি চন্দ্রশেখর ২০০৮-এর ঘটনা মনে করে বলছেন, “আমি ধোনিকে একবার বলেছিলাম ম্যাচের পর তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ধোনি উত্তর দিয়েছিল, “আমি সময় পাব কোথায়?’’ এটা ছিল ওর রক্ষণাত্মক মানসিকতার পরিচয়, বোঝাতে চেয়েছিল, এসব নিয়ে আলোচনা করার দরকার নেই। আমাকে আমার মতো করে কাজ করতে দিন। তখন আমি বুঝেছিলাম ও নিজের কাজের ব্যাপারে কতটা একরোখা। ও যেটা করতে চায়, সেটা করবেই। বুঝে গিয়েছিলাম ও সফল হতেই চলেছে। কারণ ওর নিজের একটা মাইন্ডসেট আছে, যেখানে ও অন্য কাউকে ঢুকতে দেয় না।” প্রাক্তন নির্বাচক বলছেন, ২০১৬-তে টি-২০ বিশ্বকাপ ভারতে হয়েছিল। এমনকি ধোনি আইসিসি-কেও বুঝিয়ে দিয়েছিেনল যে, জোর করে তাঁকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না। সেবার টসের পর সব দলের অধিনায়কদের মাইক্রোফোন হাতে ধরিয়ে প্রথম একাদশ ঘোষণা করাচ্ছিল আইসিসি। নাগপুরে ভারতের প্রথম ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ধোনির কাঁধেও সেই দায়িত্ব বরতেছিল। ধোনিকে যখন এটা করতে বলা হয়েছিল, ধোনির উত্তর ছিল, “আমি এরকমটা করার কথা ভাবছি না।” বাধ্য হয়ে আইসিসি-র এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
চন্দ্রশেখর আরও বলছেন যে, ধোনিকে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে সে সেটা করবেই না। কিন্তু মতামত দিলে ধোনি সেটা শুনবে এবং কাজে লাগাবে। চেন্নাই সুপার কিংসের আইপিএল ম্যাচের একটা উদাহরণ দিয়ে প্রাক্তন নির্বাচক বলছেন, অশ্বিনকে তিন ওভার বল দিয়ে থামিয়ে দেওয়া উচিত হবে। এরপর প্রথম স্ট্র্যাটেজিক ব্রেক-আপের মুরলীকে প্রথম ওভার দেওয়া হোক। তখন ব্যাটসম্যানের উইকেটে হারানোর ভয়টা সেরকম থাকে না। কিংবদন্তি বোলার বাকিটা বুঝে নেবেন। চন্দ্রশেখর আরও বলেন তিনি ধোনিকে শুধু কথাটা বলেছিলে। ধোনি সেটাই করেছিলেন। এরপর তিনি যদি এটার জন্য ধোনিকে ধন্যবাদ দিতেন, তাহলে পরেরবার ধোনি আর এরকমটা করতেনই না। ধোনি গ্যারি কার্স্টেন, স্টিফেন ফ্লেমিং ও ডানকান ফ্লেচারের মতো কোচের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই দুর্দান্ত ক্রিকেটার। কিন্তু তাঁরা সবাই ধোনির নেতৃত্ব দেওয়ার স্টাইলের সঙ্গে ওয়াকিবহাল। তারা কেউই কখনও ধোনির উপর কিছু চাপিয়ে দিতেন না।”