মাহেন্দ্রক্ষণ প্রস্তুত ছিল। ছিল হাজার হাজার ঝাড়বাতি রোশনাই। মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। তবে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম যে এভাবে অতলান্ত ট্র্যাজেডির সাগরে গোটা দেশকে ভাসিয়ে দেবেন, ভাবা গিয়েছিল?
গোটা টুর্নামেন্টে জুড়ে অপ্রতিরোধ্য ভারত। ব্যাটে-বলে প্রতিপক্ষকে দাঁড়াতেই দেননি রোহিত-কোহলি-শামিরা। আর সেই ফাইনালেই কিনা টুর্নামেন্টের সবথেকে খারাপ ম্যাচ উপহার দিয়ে দুঃখের নর্দমায় ডুবে গেল ভারত। স্লো পিচে একসঙ্গে ভারত চোক করে গেল। দমবন্ধ হয়ে গেল এই প্ৰথমবার।
ভারতীয় দলকে ফাইনালের আগেই ফেলে দেওয়া হচ্ছিল আশির দশকের দুর্ধর্ষ ক্যারিবিয়ান দল কিম্বা রিকি পন্টিংয়ের সেই অজেয় অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে। কিন্তু আসল ম্যাচই দেখিয়ে দিল ভারত যতই মনবাহারি ক্রিকেট খেলুক, পিষে দিক বিপক্ষ দলকে। কখনই সেই অজি কিংবা ক্যারিবীয় দলের সঙ্গে একাসনে বসার যোগ্যতাই রাখে না। বিগ ম্যাচ টেম্পারমেন্ট বলেও তো এক বস্তু রয়েছে! আসল ম্যাচে কিলার ইন্সটিংক্টই না থাকলে কীভাবে আসবে সেরাদের বৃত্তে থাকার পাসওয়ার্ড!
যেখানে বিচার্য হয় চাপ সমেত ম্যাচ বের করার সামর্থ্য। বড় ম্যাচে আরও দৈত্যাকার পারফরম্যান্স নিয়ে আবির্ভাব ঘটার। সেই যোগ্যতাতেই তো আহমেদাবাদে শোচনীয়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল ভারত। ব্যাটে-বলে অস্ট্রেলিয়ার থেকে যোজন দূরত্বে এগিয়ে থেকেও ভারত শুয়ে পড়ল প্ল্যানিংয়ে, নিখুঁত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে।
টস জয় এবং বোলিং নেওয়া। অনেকেই প্যাট কামিন্সের সিদ্ধান্তে নাক সিঁটিয়েছিলেন। তবে সেই সিদ্ধান্তই ম্যাচে ফারাক গড়ে দিল। প্ৰথমে বোলিং নিয়ে স্টার্ক-কামিন্সরা ভারতকে স্রেফ মুড়ে দিলেন ব্যাটসম্যান ধরে ধরে স্ট্র্যাটেজিতে। প্রতি ব্যাটসম্যানের জন্য আলাদা আলাদা কৌশল। কোহলির ফোকাসে চির ধরানো গেল বারবার ফিল্ডিং বদলে। রোহিতকে পেড়ে ফেলা গেল গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মত স্পিনারকে পাওয়ার প্লে-র মধ্যেই নিয়ে এসে।শুভমান গিলের জন্য বরাদ্দ ছিল পেস কমিয়ে থার্ড স্ট্যাম্প বরাবর বোলিং। সূর্যকুমার শান্ত রইলেন শরীর লক্ষ্য করে স্লোয়ার শর্ট বলে। প্রথম থেকেই পিচ স্লো। বল পুরোনো হতেই রিভার্স সুইং চালু। সেই রিভার্স সুইংয়েই ভারতের লোয়ার অর্ডারকে ধ্বংস করলেন স্টার্ক-কামিন্সরা।
সেই সঙ্গে অজিদের হয়ে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসাবে আবির্ভাব ঘটল ফিল্ডিং। কার্যত মিসফিল্ড হলই না। কমপক্ষে ৩০ রান বাঁচালেন অজি ফিল্ডারই। ওয়ার্নারের মত বর্ষীয়ান তারকাও বাউন্ডারি লাইনের ধারে ঝাঁপিয়ে ফিল্ডিং করলেন যুবকের ক্ষিপ্রতায়। রোহিতকে সম্ভবত টুর্নামেন্টের সেরা ক্যাচে ফিরতে হল হেডের শিকার হয়ে।
আর ভারত একবার ২৪০-এ আটকে যেতেই অজি ব্যাটাররা নিজেদের আরও নিখুঁত প্ল্যানিং নিয়ে হাজির হলেন। পাওয়ার প্লেতে বুমরা-শামির ওপর চড়াও হওয়ার ঔদ্ধত্য দেখালেন মার্শ -হেডরা।
৪৭/৩ হয়ে গিয়েও অজিরা প্যানিক বাটন প্রেস করলেন না। বরং হেড-লাবুশনে অপেক্ষা করলেন। সিঙ্গলস, ডাবলস নিয়ে কুলদীপ-জাদেজাদের ওপর পালটা চাপের খেলা চালু করলেন। বুমরা-শামি-জাদেজা হেড-লাবুশনে জুটিকে কোনও ভাবেই ভাঙতে পারলেন না। টার্গেট ছিল অল্প। তাই কৌশল সহজ ছিল। স্রেফ ক্রিজ আকড়ে পড়ে থেকে স্ট্রাইক রোটেট করা। বাউন্ডারির জন্য লুজ বলের অপেক্ষা করা।
২০০৩-এ রিকি পন্টিং, গিলক্রিস্ট ভারতের ভাগ্য পুঁতে দিয়েছিলেন ব্যর্থতার চাদরে। রবিবার সেই স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন ট্র্যাভিস হেড। চোটের কারণে টুর্নামেন্টেই খেলা নিয়ে যাঁর সংশয় তৈরি হয়েছিল। বিশ্বকাপে কিউই ম্যাচে খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি করে গিয়েছিলেন। আর ফাইনালের মঞ্চে টুর্নামেন্টের সেরা বোলিং লাইনআপকে সাধারণ স্তরে নামিয়ে আনলেন হেড। হেডের ব্যাটে ভর করেই এল অজিদের ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ জয়। ভারতের চিরকালীন নেমেসিস হয়ে গেলেন তিনি। ১২০ বলে ১৩৭ করে যখন ফিরলেন তখন জয় থেকে মাত্র ২ রান দূরে অস্ট্রেলিয়া।
ভারত কি নিজেরাই নিজেদের স্বপ্নভঙ্গের জন্য দায়ী নন? চলতি ওয়ার্ল্ড কাপে বারবার পিচ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। এমনকি ওয়াংখেড়েতেও ভারতের বিপক্ষে পিচ বদলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়ে কি ভরসাই ছিল না রোহিতদের? আহমেদাবাদেও ভারতের চাহিদা মেনেই ম্যাচ হল টুর্নামেন্টের অন্যতম মন্থর পিচে। এমন পিচ ব্যাকফায়ার করতে পারে, তা ভেবেও কেন সহজ সাধারণ উইকেটের পথে হাঁটল না ভারতীয় দল।
ফলস্বরুপ যা হওয়ার সেটাই হল। মন্থর পিচ। দ্বিতীয়ার্ধে শিশিরের জন্য বোলিং অনেকটাই চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়াল, তেমন ব্যাটিংও তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে এল।
কপিল দেব, মহেন্দ্র সিং ধোনিদের সঙ্গে একই পংক্তিতে বসার কথা ছিল রোহিত হিটম্যান শর্মার। তবে তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দুৰ্ভাগ্যের সরণিতে পা রাখলেন। ২০০৩-এর বদলা এল না। সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজিক দল হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলল ভারত।