বাঁ হাতি পেসাররা বরাবর ভারতের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। অতীতে অভিষেক সিরিজের মুস্তাফিজুর রহমান, রিস টপলে, শাহিন শাহ আফ্রিদি, ট্রেন্ট বোল্ট ভারতীয় ব্যাটিংকে নাস্তানাবুদ করেছিল। সেই তালিকায় নতুন সংযোজন হতে চলেছেন হয়ত দীর্ঘদেহী প্রোটিয়াজ স্পিডস্টার।
মহা পরীক্ষায় বসার আগে শনিবার ভারতীয় ব্যাটাররা মহড়া চালালেন পুরোদস্তুরভাবে। নেট অনুশীলনে একজন বাঁ হাতি লম্বা বোলারকে ফেস করলেন কোহলি-গিলরা। কোহলি তাঁকে শরীর লক্ষ্য করে শর্ট বল করতে বললেন। কেএল রাহুল পঞ্চম-ষষ্ঠ স্ট্যাম্প বরাবর বোলিং করতে বললেন। শুভমান গিল আবার ইডেনে সেই দীর্ঘদেহী নেট বোলারকে অনুরোধ করলেন তাঁকে যেন ১৮-১৯ গজ থেকে উচ্চতা সমেত বল করা হয়।
আর যাঁর জন্য ভারতীয় ক্যাম্পে এমন আয়োজন, তিনি মার্কো জ্যানসেন। আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলার সূত্রে ভারতীয় ব্যাটাররা অনেকটাই পরিচিত যাঁর সঙ্গে। তবে এবার মার্কোর উত্তুঙ্গ ফর্ম ভাবতে বাধ্য করছে ভারতীয় দলকেও।
জ্যানসেন বাকি বাঁ হাতি পেসারদের থেকে অনেকটাই আলাদা উচ্চতার কারণে। ২.০৬ মিটার উচ্চতা। পিচ থেকে অতর্কিতে বাউন্স আদায় করে নিতে পারেন স্রেফ উচ্চতার সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে। গুড লেন্থের বল আচমকা বাউন্স আদায় করে ব্যাটসম্যানের কাছে ধেয়ে আসে সুতীব্র গতিতে, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ব্যাটসম্যান ফ্রন্টফুটে ড্রাইভ করার আগে অন্তত দু-বার ভাবেন। আর ফুলার লেন্থের বল ড্রাইভ করলেই পিছনে ক্যাচ উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ব্যাটের কানায় লেগে। মার্কো জ্যানসেন রবিবার ভারতীয় ব্যাটিংয়ের পরীক্ষা নেবেন বেশ কড়া হাতেই।
বৃহস্পতিবার প্ৰথম ঘন্টায় লঙ্কান পেসার মধুশঙ্কা ঘাম উড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় ব্যাটারদের। রোহিত আউট হওয়ার পর গিল-কোহলি নিজেদের সমস্ত স্কিল-সামর্থ্যকে হাতিয়ার করে দলের বিপর্যয় রোধ করেন। আর এবার সামনে মার্কো জ্যানসেনের চ্যালেঞ্জ। যাঁকে বলা হচ্ছে বাঁ হাতি কাইল জেমিসন। দীর্ঘদেহী কিউই সিমার ভারতীয় সিমারদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। তবে জেমিসনের থেকেও নিখুঁত লাইন-লেন্থে টানা বোলিং করে যান জ্যানসেন। ১৬ উইকেট দখল করে তিনি ওয়ার্ল্ড কাপের শীর্ষ উইকেট শিকারিদের অন্যতম। ভারতের ব্যাটিং পিচে তাঁর ইকোনমি রেট মাত্র ৫.৮৩। প্রতি ২০ বল অন্তর উইকেট শিকার করছেন তিনি।
এই ১৬ উইকেটের ১২ উইকেট-ই প্রোটিয়াজ সিমার দখল করেছেন পাওয়ার প্লেতে। বিশ্বকাপের শুরুতে সেভাবে কার্যকর হচ্ছিলেন না। তবে সময় যত গড়িয়েছে ততই মারণ ফর্মে ফিরেছেন জ্যানসেন। টুর্নামেন্টের প্ৰথম দিকে লেন্থের সঙ্গে সেভাবে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ফুলার লেন্থে বল করে সুইং আদায় করার চেষ্টা করছিলেন। তবে এখন লেন্থের সামান্য রদবদল ঘটিয়েছেন। 'হিট দ্য ডেক' লেন্থে বল করেই আরও ভয়াবহ তিনি।
ভয়াবহ গতির বাউন্স মার্কো জ্যানসেনের তূনের সেরা অস্ত্র। এমনিতে গিল, রোহিত শর্ট বলে দারুণ স্বচ্ছন্দ। পুল শটে সিদ্ধহস্ত। কোহলি আবার ইনিংসের শুরুতেই নিজের ঘাড় লক্ষ্য করে ধেয়ে আসা শর্ট বলে সেভাবে স্বচ্ছন্দ থাকেন না। চিপকে এই কারণেই জোস হ্যাজেলউড কোহলিকে শর্ট বলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তবে একবার ক্রিজে সেট হয়ে গেলেন বিরাটের পক্ষে সেই শর্ট বলের মোকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। শ্রেয়স আইয়ারের শর্ট বলের দুর্বলতা তো চলতি বিশ্বকাপে বারবার প্রকট হয়ে গিয়েছে। কেএল রাহুল এই মার্কো জ্যানসেনের বলেই শিকার হয়ে ফিরেছেন টেস্টের আঙিনায়। একবার, দু-বার নয়, তিন-তিনবার। কখনও ফুলার লেন্থের বল ড্রাইভ করতে গিয়ে, কখনও পুল হাঁকাতে গিয়ে টপ এজিং করে, কখনও আবার রক্ষণাত্মক খেলতে গিয়ে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ তুলে আউট হয়েছেন এই মার্কো জ্যানসেনের বলে।
দক্ষিণ আফ্রিকার পেস আক্রমণ এমনিতে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা। মার্কো জ্যানসেনের মত বিস্ময় প্রতিভা তো রয়েইছে, সঙ্গে রয়েছেন আধুনিক ক্রিকেটের মাস্টার কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিদি, জেরাল্ড কোয়েটজের মত পরীক্ষিত স্পিড-গানরা। দক্ষিণ আফ্রিকানদের এতটাই সমৃদ্ধ পেস আক্রমণ যে এনরিখ নখিয়ার মত পেসারের অভাব একবারের জন্যও অনুভূত হয়নি বিশ্বকাপে।
মার্কো জ্যানসেন বেড়ে ওঠার বয়সে চেয়েছিলেন রাগবি খেলতে। তবে এই উচ্চতার কারণেই জ্যানসেনের পিতা বোলার হওয়ার পরামর্শ দেন পুত্রকে। তারপরেই বিশ্বক্রিকেটে উড়িয়ে দেওয়া আত্মপ্রকাশ তরুণ তুর্কির।
রবিবারের ম্যাচের ফলাফলের চাবিকাঠি অনেকটাই যে মার্কো জ্যানসেন নামক আতঙ্ককে ভারতীয় ব্যাটারদের প্ৰথম ঘন্টায় নতুন বলে সামলানোর দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে, তা বলাই বাহুল্য।