Advertisment

শামির কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন এই বাঙালি! নীরবে, নিভৃতেই স্বপ্ন বুনছেন বিশ্বজয়ের

শামির কেরিয়ারে সবথেকে বড় সিদ্ধান্ত নেন এই বাঙালি

author-image
Subhasish Hazra
New Update
shami-monayem

শামির কেরিয়ারে বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আব্দুল মোনায়েম (টুইটার এবং ফেসবুক)

সেই সময়ের কথা এখনও সযত্নে মনে করতে পারেন তিনি। সেই সময় কলকাতার ক্লাব ক্রিকেটে চুটিয়ে খেলছেন মহম্মদ শামি নামের সম্ভবনা ময় এক তরুণ। স্যরি ভুল হল। মহম্মদ শামি তখনও তিনি নন। শামি আহমেদ কলকাতার ক্লাব ক্রিকেটে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন। প্ৰথমে ডালহৌসি, তারপর টাউন ক্লাবের হয়ে আগুনে পেস, সুইংয়ে নাস্তানাবুদ করছেন প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের।

Advertisment

ক্লাব ক্রিকেটে ঝড় তুলে দেওয়া শামি আহমেদকে মোহনবাগানে নিয়ে আসার সেই কারিগর আজও আচ্ছন্ন সেই স্মৃতিতে। আব্দুল মুনায়েম। কলকাতার ক্লাব ক্রিকেটে যাকে মহাগুরু মানা হয়। তিনি তৃণমূল স্তরে কোচিংয়ের সুবাদে পরিচিত ছিলেন মোরদাবাদের ক্রিকেট প্রশিক্ষক বদরুদ্দিন সিদ্দিকির সঙ্গে। এই বদরুদ্দিনই তখন সেই শামি আহমেদের মেন্টর। উত্তরপ্রদেশের এক ট্রায়াল থেকে বদরুদ্দিনের জহুরি চোখ টিন এজার শামিকে চিনতে সেই সময় ভুল করলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের নেমেসিস হয়ে ধরা দিতে পারতেন শামি? সংশয় রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের রাজ্য স্তরে যুব ভিত্তিক ক্রিকেটে রাজনৈতিক প্রভাবের রমরমা। এমন পরিবেশে উঠতি সেই প্রতিভা যে বারবার ঠোক্কর খাবে, বুঝে গিয়েছিলেন অচিরেই।

শামিকে মোরদাবাদ থেকে বদরুদ্দিন সটান পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। তারপরের ঘটনা কমবেশি অনেকেরই জানা। প্ৰথমে কলকাতা, তারপর বাংলা এবং শেষে দেশের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সিংহাসন আদায় করে নেওয়া- শামি আহমেদ থেকে মহম্মদ শামি নামের বদলের সঙ্গেই রূপকথার উত্তরণ ঘটেছে দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা আইকনের।

বদরুদ্দিন যদি শামি নামক ব্লকবাস্টার ছবির ডিরেক্টর হন, তাহলে তাতে অন্যতম চরিত্র হিসাবে থাকবেন-ই বাংলার আব্দুল মুনায়েম। টাউন ক্লাব, ডালহৌসিতে তোলপাড় ফেলে দেওয়ার পর বন্ধু বদরুদ্দিন এবং শামি-দুজনকেই একান্তে বোঝান রাজ্য দলে সুযোগ পেতে হলে মোহনবাগানের মত লব্ধপ্রতিষ্ঠ ক্লাবে নাম লেখানো দরকার। সেখানে পারফর্ম করলেই খুলে যেতে পারে রাজ্য দলের দরজা। দেশের সামনে নিজেকে চেনানোর মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে রাজ্য স্তরে নির্বাচন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মোনায়েম আরও জানিয়েছেন, "সেই সময় শামিকে মোহনবাগানে খেলতে রাজি করানো মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কলকাতায় শামি নিজের গডফাদার মানত টাউন ক্লাবের সচিব দেবব্রত দাসকে। সেই কারণেই টাউন ছাড়তে অনিচ্ছুক ছিল ও। বদর ভাই সরাসরি শামির ইগোয় ধাক্কা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, লোয়ার ডিভিশনের ক্লাবে খেলে উইকেট নিয়ে শামি যদি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে সেটাই হোক। অনেক কষ্টে শামিকে বোঝানো সম্ভব হয় যে মোহনবাগানে খেললে বাংলার নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হবে। তারপরেই শামি বাংলা তো বটেই ২০১১-য় কেকেআরেও জায়গা পেয়ে যায়।"

মুনায়েমের পরামর্শ শেষ পর্যন্ত শামির কেরিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। মোহনবাগানে খেলার সময়েই সৌরভকে একবার নেটে বল করার সুযোগ জোটে। তারপর মহারাজ স্বয়ং বাংলার নির্বাচকদের শামির নাম রেকমেন্ড করেন।

২০১০/১১ রঞ্জি দলে সুযোগ পাওয়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতরিয়ে উসেইন বোল্টের গতিতে এগিয়েছে শামির কেরিয়ার।

কাট টু, ২০২৩ বিশ্বকাপ: বাংলার সেই অপরিচিত মহম্মদ শামিই তছনছ ফেলে দিয়েছেন বিশ্বকাপে। সেরাদের ব্র্যাকেটে নিজেকে নিয়ে গিয়েছে। গ্রুপ পর্বে প্ৰথম চার ম্যাচ না খেলেই শামির নামের পাশে ২৩ উইকেট। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিদের তালিকায় তিনিই শীর্ষে।

মোহনবাগান-পর্ব না হলে শামি কি আজকের শামি হতে পারতেন? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বিনয়ের অবতার হয়ে সেই মোড় ঘোরানো অধ্যায়ের নায়ক আব্দুল মুনায়েম জানাচ্ছেন, "শামির শামি হয়ে উঠতে কারোর সাহায্যের প্রয়োজন হত না। ও এমনিতেই নিজের যোগ্যতায় এই পর্যায়ে পৌঁছত।" ভবানীপুরে কোচিং করিয়েছেন। তারপর মোহনবাগান হয়ে বর্তমানে তিনি ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্বে। বঙ্গ ক্রিকেটের দ্রোনাচার্য সেই পুরোনো অধ্যায়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে যেন থামছিলেন-ই না।

এক নিঃশ্বাসে বলছিলেন, "শামি কিন্তু নিজেকে মাজাঘষা করে এই পর্যায়ে তুলে আনেননি। সিম পজিশন ওঁর সহজাত প্রতিভা হিসাবেই ছিল। কলকাতায় এভাবেই ও বিপক্ষ ব্যাটসম্যানের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিত। ওঁর রিস্ট পজিশন, ছন্দময় দৌড়, আর সেই সঙ্গে সিম পজিশন তো রয়েইছে। ওঁর সবথেকে বড় অস্ত্র লেট সুইং করানোর ক্ষমতা। এমনিতে ব্যানানা সুইং পড়ে ফেলা যায়। তবে শামির বল যে সময়ে ভাঙে, সেখানে বিপক্ষ ব্যাটারদের কিছু করার থাকে না। হিট দ্য ডেক বল পিচ করিয়ে যে কোনও পিচ থেকে ও বাউন্স আদায় করে নিতে পারে। সেই সঙ্গে গতির জন্য ও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।"

দলগত কম্বিনেশনের জন্য প্ৰথম চার ম্যাচে শামিকে বাদ দিয়েই দল সাজিয়েছিল ভারত। তবে এতে মোটেই সন্তুষ্ট নন লাল-হলুদের বর্তমান ক্রিকেট-বস। জানিয়েছেন, "শামি সবসময় দলের ফার্স্ট চয়েস হওয়া উচিত। কাকে বসাবে টিম ম্যানেজমেন্ট সেটা ঠিক করবে। কিন্তু শামিকে বসিয়ে রাখা উচিত হয়নি।"

মাঠের মধ্যে ঝলসে দেওয়া পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম ৫০ উইকেটের মালিক। জাহির খানদের মত কিংবদন্তিকে পেরিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে টিম ইন্ডিয়ার মুখ হয়ে ওঠা- কোনওদিন শামিকে কোচিং না করিয়েও গর্বে বুক ভরে ওঠে মুনায়েমের। তিনি অবশ্য শামির একের পর এক ইতিহাস গড়া পারফরম্যান্স-এর নেপথ্য কারণ হিসাবে ধরছেন টিম ইন্ডিয়ার বর্তমান কোচিং স্টাফকে। বলছেন, "মাঠে রোহিতদের মতই যেন মাঠের বাইরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার এই কোচিং স্টাফ। দুর্ধর্ষ প্ল্যানিং করে ওঁরা প্রত্যেক ম্যাচে খেলতে নামছে। রাহুল দ্রাবিড় তো বটেই বোলিং কোচ পরশ মামব্রের কথাও বলতে হয়। পরশের আগে বাংলায় কোচিং করানোর সূত্রে শামির সঙ্গে পরিচয় ছিল। এবার জাতীয় দলের যুগলবন্দিতে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠছে।"

বারো বছরের অপেক্ষার পর ভারত আবার বিশ্বকাপের ফাইনালে। প্রতিপক্ষ কে ঠিক করে দেবে রবিবার ইডেনের মহারণ-ই। ফাইনালে দেশের জন্য তো বটেই আব্দুল মুনায়েমের বুক ধুকপুক করবে সেই ছাত্রের জন্য। যাঁকে কোনওদিন কোচিং না করিয়েও তাঁর ঐতিহাসিক সাফল্যের অন্যতম পার্শ্বনায়ক হয়ে উঠেছেন নিজের অজান্তেই।

Mohunbagan Mohun Bagan Cricket Association Of Bengal ICC Cricket World Cup Cricket World Cup Mohammed Shami
Advertisment