৪০ দিন আগে ভারত অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল নিজেদের গ্রুপ পর্বের প্ৰথম ম্যাচেই। তারপর ভারত বিশ্বকাপে অজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে ৪১তম রাতে এসে ভারতের বশ্যতা স্বীকার করল সেই অজিদের কাছেই। আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে বড় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার অতিমানবীয় হয়ে ওঠা নাকি স্রেফ একটা খারাপ ভাগ্য ভারতকে বিশ্বকাপ জয় থেকে দূরে সরিয়ে দিল? এই হার নিয়ে লাখো লাখো পোস্ট মর্টেম করা হবে আগামীদিনে। তবে একদম নিখুঁত বিশ্লেষণে বলাই যায়, ক্রিকেটীয় কারণেই ভারতের এই হার।
প্রত্যেকবার বড় ম্যাচে যেন ভারতের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে হার। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিনেই ভারত এমন এক দলের মুখে পড়বে যাঁরা স্রেফ পরিকল্পনার চাদরে মুড়ে ফেলবে ভারতকে। অতীতে বহুবার এমন হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশনই যেন বজায় রাখল অস্ট্রেলীয়রা।
অজিরা হোমওয়ার্ক করেই খেলতে নেমেছিল। আর ক্যাঙারুদের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায় ক্যাপ্টেন প্যাট কামিন্স টস জেতায়। তারপর ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। প্রথাগত যে ক্রিকেট বুদ্ধি, তার ধারেকাছেও যায়নি অজিরা। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের আস্থা রেখেই কামিন্স বাহিনী কৌশল সাজিয়েছিল। অজি তারকাদের ক্রিকেটের হাতেখড়িই হয় বাউন্সি পিচে। সেই প্রাথমিক ক্রিকেট শিক্ষা ভুলে অস্ট্রেলিয়া স্লো ঢিমেতালে পিচে দাদাগিরি দেখিয়ে গেল।
ঘটনা হল, ভারতকে জয়ের স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই স্লো পিচে তৈরি করা হয়েছিল। তবে ভারতের সেই স্ট্র্যাটেজিই বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। কোচ রাহুল দ্রাবিড় ম্যাচের তিনদিন আগেই পিচ পরিদর্শনে এসেছিলেন। এমন নয় যে হঠাৎ করেই অজানা পিচে নামতে হয়েছিল কোহলি-রোহিতদের। তবে পিচের থমকে আসা চরিত্রই ভারতকে বিশ্বকাপ জয় থেকে দূরে সরিয়ে দিল। এই পিচেই গত মাসে পাকিস্তানকে বধ করেছিল টিম ইন্ডিয়া।
স্লো পিচে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কীভাবে বল করতে হবে, তা নিখুঁত প্ল্যানিং করে নেমেছিল অজিরা। ভারতের প্রত্যেক ব্যাটারের জন্য আলাদা আলাদা ফিল্ড প্লেসমেন্ট, এবং বোলিং কৌশল- এই ছকেই বাজিমাত। সিমাররা ফুল লেন্থে বল করা থেকে বিরত থাকল। স্পিনাররাও গতি কমিয়ে বল করলেন। মাঠে অজিরা ফিল্ডিং করছিল এমনভাবে মনে হচ্ছিল, হয়ত জীবন-মরণ নির্ভর করছে সামান্য এক রান সেভ করা নিয়ে।
আহমেদাবাদে যে ম্যাচ খেলা হয়েছে, সেই প্যাটার্ন নিয়ে পুরোপুরি অবহিত ছিল অজিরা। টুর্নামেন্টের প্ৰথম ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের সিমার এবং স্পিনাররা থমকে আসা বলে পেড়ে ফেলেছিল ইংল্যান্ডের হেভিওয়েট ব্যাটিং।
ফ্লাডলাইটে রান চেজ করা আহমেদাবাদে সহজ হয়ে যায় শিশির প্রভাব ফেলায়। কিউই ব্যাটাররা ২৮৩ রান চেজ করেছিল হাতে নয় উইকেট নিয়ে। সেই প্যাটার্ন-ই দেখা গেল বিশ্বকাপের ফাইনালে। সাম্প্রতিক অতীতে পিচের এই চরিত্র পর্যবেক্ষণ করেই অস্ট্রেলিয়া বোলিংয়ের সহজ সরল স্ট্র্যাটেজি কষেছিল। যার।মোদ্দা কথা হল- পিচকে ব্যবহার করতে হবে। বল ঠিক জায়গায় হিট করতে হবে এবং ব্যাটারদের কাছে স্লো পিচের ফায়দা নিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করতে বাধ্য করা। গতি কমিয়ে অজিরা বোলিং করতেই নাভিশ্বাস উঠে গেল ভারতের। সেই বোলিং থিমের সঙ্গে যুক্ত হল একাধিক অস্ত্র- স্লো অফ কাটার, কাটার, স্লোয়ার বাউন্সার, নিয়মিত বাউন্সার, ব্যাক অফ দ্য লেন্থে সিম আপ বোলিং করা। পিচের চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই স্ট্র্যাটেজিতে মাত হয়ে গেল ভারতের ফর্মে থাকা ব্যাটিং লাইন আপ।
সেই সঙ্গে যুক্ত হল ফিল্ডারদের অনবদ্য ক্ষিপ্রতা। এক বাউন্সে উইকেটকিপারের কাছে থ্রো করতেই হবে। এমন মানসিকতা নিয়ে খেললেন অজিরা। দুই প্রান্তে ভারতীয় ইনিংসে জোড়া বল ব্যবহার করা হল। দুটোই ম্যাচ শেষে মনে হচ্ছিল ১০০ ওভার পুরোনো। রং উঠে যাওয়া নরম।
আর এই বলেই রিভার্স সুইংয়ে বাজিমাত করলেন স্টার্ক-হ্যাজেলউডরা। কেএল রাহুল ক্রিজে টিকে গিয়েও এই রিভার্স সুইংয়ের শিকার হয়ে ফিরলেন। গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে এমন স্লো পিচে একাধিকবার ভারতীয় বোলিং দমবন্ধ করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের। ফাইনালেও ভাবা হয়েছিল মারণ মূর্তি ধরবেন বুমরা-শামিরা। স্ক্রাম্বলড সিমার সিরাজের তুলনায় নতুন বল হাতে শামির ওপর বেশি ভরসা রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন রোহিত শর্মা। জসপ্রীত বুমরা এবং শামি যথারীতি নিজেদের দুর্দান্ত ফর্ম জাহির করে অজি টপ অর্ডারকে মুড়িয়ে দিয়েছিলেন শুরুর দিকে। ওয়ার্নার, মার্শ সহজেই ফিরে গিয়েছিলেন। বুমরার অফ কাটার স্মিথকে ফেরানোর পর ৪৭/৩ হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। তবে তারপরই গোটা ম্যাচ জুড়ে ভারতের ভাগ্য রোহিতদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে গেল।
শেষের দিকে পিচ সহজ হয়ে গেল। ৭ ওভার বাকি থাকতেই চ্যালেঞ্জিং স্কোর টপকে গেল অস্ট্রেলিয়া। ভারতের পিচ স্ট্র্যাটেজি কোনও কাজেই আসল না। কামিন্স ম্যাচের আগেই জানিয়েছিলেন, যে পিচ দেওয়া হবে, সেই পিচের জন্যই তাঁরা প্রস্তুত। ট্র্যাভিস হেড পুরোনো সেই আপ্তবাক্যই আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন- বড় ম্যাচে নার্ভ বাঁচিয়ে কীভাবে জিততে হয়, প্রতিপক্ষকে পেড়ে ফেলতে হয়, এবং লাখো লাখো দর্শকরা নিস্তব্ধতা উপহার দিতে হয়, সেই সম্পর্কে তাঁরা ভালোই সচেতন।