নিউজিল্যান্ড: ২৭৩/১০
ভারত: ২৭৪/৬
দানবীয় ফর্মে কোহলির। টিম ইন্ডিয়াও সেরা ছন্দে। তুখোড় ফর্মের ভারতের সামনে এবার নতজানু হল বিশ্বকাপে টানা চার ম্যাচ অপরাজেয় থাকা নিউজিল্যান্ড। প্রথমে মহম্মদ শামির স্মরণীয় পাঁচ উইকেট। তারপর কোহলির সেই অতিমানবীয় ব্যাটিং। বিশ্বকাপে কোনওভাবেই থামানো যাচ্ছে না টিম ইন্ডিয়াকে। নিউজিল্যান্ডের ২৭৬ রানের টার্গেট ভারত চেজ করল রুদ্ধশ্বাসভাবে। হাতে ৪ উইকেট, ১২ বল নিয়ে।
শচীনকে ছুঁয়ে ওয়ানডেতে ঐতিহাসিক ৪৯তম শতরান করে ফেরার মঞ্চ তৈরি গিয়েছিলেন কোহলি। বাংলাদেশ-ম্যাচের সেই সেঞ্চুরির রোমাঞ্চ সঙ্গে নিয়ে। মাঝে হঠাৎ একাধিক উইকেট পতনে ভারত চাপে পড়ে গিয়েছিল। তবে জাদেজার সঙ্গে ৭৮ রানের পার্টনারশিপে জয় নিশ্চিত করার পরে কোহলি সেঞ্চুরির ঠিক পাঁচ রান আগে আউট হয়ে যান।
পরিসংখ্যান বলছে ৩৪ বার রান চেজ করে ৩৩ বার-ই দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন কোহলি। সেই ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান রবিবারও অক্ষুণ্ন রাখলেন কিংবদন্তি।
চলতি বিশ্বকাপে ভারতের জয় একই ভঙ্গিতে। একই প্যাটার্নে। প্ৰথমে প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে পাঠানো। তারপরে বিপক্ষের কোনও এক জুটির চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেওয়া ভারতকে। তারপরে ভারতীয় বোলারদের কামব্যাক এবং বিলো-পার স্কোরে প্রতিপক্ষকে আটকে রেখে সহজভাবে রান চেজ করে জয়। অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ- সব ম্যাচেই কমবেশি এই একই ভঙ্গিতে এসেছে জয়। সেই ফর্মুলাতেই এল রবিবারের জয়।
তবে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের শুরুর কয়েক ওভার বাদ দিয়ে কোনও ম্যাচেই ভারতের রান চেজ দুশ্চিন্তার লগ্ন পেরোয়নি। কিউই ম্যাচ কিন্তু ভারতের ব্যাটিংকে উদ্বেগের মধ্যে বারবার ঠেলে দিল। তবে কিং কোহলি থাকায় সেই উদ্বেগ জয়ের নিশ্চয়তায় বদলে যেতে সমস্যা হয়নি।
টসে জিতে ভারত প্ৰথমে ব্যাট করতে পাঠিয়েছিল নিউজিল্যান্ডকে। প্ৰথম দশ ওভারে কিউই ব্যাটিংয়ে শান্ত রেখেছিলেন বুমরা-সিরাজরা। তবে ধর্মশালার প্রাথমিক চাপ সামলে ভারতকে পাল্টা লড়াইয়ে ঠেলে দেন রচিন রবীন্দ্র-ড্যারেল মিচেল জুটি। মাঝের ওভারে ভারতীয় বোলারদের কার্যত তুলোধোনা করতে থাকেন দুই কিউই ব্যাটার।
মহম্মদ শামি আক্রমণে এসে প্ৰথম বলেই আউট করেন উইল ইয়ংকে। মহম্মদ সিরাজও তুলে নেন অন্য ওপেনার ডেভন কনওয়েকে। ১৭/২ হয়ে যাওয়ার পরেই নিউজিল্যান্ড ম্যাচে ফেরে রবীন্দ্র-মিচেল পার্টনারশিপে। হার্দিকের চোটে ভারতের প্ৰথম এগারোর কম্বিনেশন ঢেলে সাজাতে হয়েছে। হার্দিকের জায়গায় দলে এসেছেন সূর্যকুমার যাদব। শার্দূলকে বসিয়ে অবশেষে জায়গা হয়েছিল শামির। মাত্র পাঁচ বোলারেই খেলতে নামতে হয়েছিল টিম ইন্ডিয়াকে।
আর মিডল ওভারে রচিন রবীন্দ্র-মিচেলের পার্টনারশিপ চলাকালীন ভালভাবে অনুভূত হল ষষ্ঠ বোলারের অভাব। কুলদীপ নিজের প্ৰথম স্পেলে ব্যাপক রান খরচ করে বসেছিলেন। প্ৰথম তিন ওভারেই ৩২ রান বিলিয়ে দেন তিনি। এমন অবস্থায় রোহিত জাদেজার পুরো কোটার ওভার ব্যবহার করে নিতে বাধ্য হন।
কিউইদের ১৫৯ রানের পার্টনারশিপে শেষ পর্যন্ত ভাঙন ধরান সেই মহম্মদ শামি। ৮৭ বলে ৭৫ করে শেষ পর্যন্ত আউট হন রচিন রবীন্দ্র। আর ব্রেক থ্রু দেওয়ার পর থেকেই ভারত ম্যাচে কামব্যাক করে। কুলদীপ দ্বিতীয় স্পেলে নিজের প্রথম স্পেলের পাপস্খালন করে যান। টম ল্যাথামকে ফেরান তিনি। গ্লেন ফিলিপসকে সাততাড়াতাড়ি আউট করেন তিনি।
ড্যারেল মিচেল একপ্রান্তে টিকে ১২৭ বলে ১৩০ করে গেলেও অন্যপ্রান্তে উইকেট পতনের সঙ্গেসঙ্গেই রান তোলার গতি বাড়াতে পারেনি ব্ল্যাক ক্যাপসরা। শেষ ১০ ওভারে মাত্র ৫৮ তুলতে সমর্থ হয় নিউজিল্যান্ড। ড্যারেল মিচেলকে আউট করার সঙ্গেই শামি ৪৮তম ওভারে মিচেল স্যান্টনার, মার্ক চ্যাপম্যানকে বোল্ড করে নিজের ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার কমপ্লিট করেন। পরপর জোড়া উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভবনাও জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে রোহিত শর্মা-শুভমান গিল প্রত্যাশিত ভঙ্গিতে ঝোড়ো সূচনা উপহার দিয়েছিলেন। ৭১ রানের পার্টনারশিপের অধিকাংশই এসেছিল বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি থেকে। তবে লকি ফার্গুসন আক্রমণে এসে প্ৰথম বলেই প্লেড অন করে দেন রোহিতকে। হাফসেঞ্চুরি (৪৬)র ঠিক আগেই ফেরেন ক্যাপ্টেন রোহিত। তারপরে শুভমান গিলকেও ফিরিয়ে ভারতকে চাপে ফেলে দিয়েছিলেন কিউই স্পিডস্টার। তৃতীয় উইকেটে শ্রেয়স আইয়ারকে সঙ্গে নিয়ে কোহলি ৫২ রান যোগ করে যান। যখন মনে হচ্ছিল শ্রেয়স ক্রিজে জমে গিয়েছেন, সেই সময়েই শর্ট বলের ফাঁদে ফেলে তারকাকে (২৯ বলে ৩৩) ফেরান ট্রেন্ট বোল্ট।
শ্রেয়স ফেরার পর কেএল রাহুলকে সঙ্গে নিয়েও হাফসেঞ্চুরি পার্টনারশিপ গড়ে যান কোহলি। তবে মাঝে মিচেল স্যান্টনারের বলে রাহুল ফেরার পরেই সূর্যকুমার যাদব ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে যান। ভারত সেই সময় ১৯১/৫ হয়ে গিয়ে প্ৰবল চাপে পড়ে গিয়েছিল। তবে রবীন্দ্র জাদেজাকে সঙ্গে নিয়ে ফিনিশিং লাইন পার করতে কোহলির কোনও সমস্যাই হয়নি।
আইসিসি টুর্নামেন্টে শেষবার ভারত নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল সেই ২০০৩ বিশ্বকাপে। দক্ষিণ আফ্রিকায়। তারপর কেটে গিয়েছে দু-দশক। ২০১৯-এ ইংল্যান্ডের মাঠে কিউইদের কাছে হার এখনও দগদগে। রবীন্দ্র জাদেজা সেদিন অমানবিক চেষ্টা করেও দলকে ফিনিশিং লাইন পের করতে পারেননি। মাঝে ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হারতে হয়েছে। তবে দীর্ঘ দুই দশকের সেই বৃত্তের একটা ধাপ সম্পূর্ণ হল রবিবার ধর্মশালায়। যে জাদেজার ব্যাটে গত বিশ্বকাপের সেমিতে কিউইদের পাল্টা চাপে ফেলে দিয়েছিল, সেই তারকার ব্যাটেই এল ভারতের এদিনের উইনিং স্ট্রোক। ক্রিকেট যা কিছু নেয়, ফিরিয়েও দেয় বই কী!