ধোনিদের ছুঁয়ে রেকর্ড ভারতীয় মহিলা দলের! ১৬ বছর আগের কাণ্ড ঘটিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইন্ডিয়া, এমন এক দারুণ মুহূর্তে, চাইনিজ নয়, ডাল-ভাত আর ভাজাতেই হবে সেলিব্রেশন, এমনটাই জানিয়েছেন ভারতীয় যুব মহিলা দলের সদস্য তিতাস সাধুর বাবা রণদীপ সাধু। প্রিয় খাবার বলতে চাইনিজ। তিতাসকে জয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছে ঝুলন গোস্বামী সহ একাধিক তারকারা। তিতাসের জয়ে দেশের সঙ্গে সঙ্গে চুঁচুড়ায় তিতাসের পরিবারে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। কঠিন অনুশীলনেও ডায়েটে ছেদ পড়েনি। বাড়ি ফিরে এসেও সেই রেশই বজায় রাখতে চায় তিতাস। লক্ষ্য আগামীতে আরও পরিণত খেলা দেশকে উপহার দেওয়া।
কয়েকদিন আগেই মহিলাদের আইপিএল সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছে। সেই আইপিএল ঘোষণার সঙ্গেই সঙ্গতি রেখে এবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল ভারত। মহেন্দ্র সিং ধোনিদের কীর্তি স্পর্শ করে অনুর্দ্ধ-১৯ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল মহিলাদের যুব টি২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেরার সেরা মুকুট পড়লেন জাতীয় যুব দলের মহিলা তারকারা।
ফাইনালে ভারতের জয়ের পুরো কৃতিত্বই প্রাপ্য বোলারদের। টসে জিতে ফিল্ডিং নেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন শেফালি ভার্মা। প্ৰথমে ব্যাট করতে নেমে দুর্ধর্ষ ভারতের বোলিং আক্রমণের মুখে ইংল্যান্ড ব্যাটিং লাইন আপ ধসে গিয়েছিল মাত্র ৬৮ রানে। বল হাতে আগুনে পারফরম্যান্স করে যান তিতাস সান্ধু। প্ৰথম ওভারেই তুলে নেন ফর্মে থাকা লিবার্টি হোপকে। অফস্পিনার অর্চনা দেবীর ঘূর্ণি বলও সামলাতে ব্যর্থ ইংরেজ মহিলারা।
তিতাস সান্ধু, অর্চনা দেবী, পরশভি চোপড়া প্রত্যেকেই দুটো করে উইকেট নেন। শেফালি ভার্মা, মন্নত কাশ্যপ, সোনম যাদবও একটি করে উইকেট নিয়েছেন। তবে সামান্য এই টার্গেট তাড়া করতে নেমে ভারতীয়দের শুরুটাও ভালো হয়নি। ক্যাপ্টেন শেফালি (১৫) এবং শ্বেতা শেরাওয়াত শুরুতেই অথ্যে যাওয়ায় বিপদে পড়ে গিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। সেখান থেকে ভারতকে উদ্ধার করে সৌম্য তিওয়ারি (২৪) এবং গঙ্গাদি তৃষার (২৪) পার্টনারশিপ। এই পার্টনারশিপে ভর করেই ভারত শেষ পর্যন্ত ৬ ওভার বাকি থাকতে জয় ছিনিয়ে নেয়।
মহিলাদের ক্রিকেটে এই প্ৰথমবার ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল। এর আগে ওয়ানডে এবং টি২০ ফরম্যাটে সিনিয়র পর্যায়ে ভারত তিনবার ফাইনালে উঠেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ২০০৫ এবং ২০১৭-য় মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত ফাইনালে উঠেও রানার্স হয়। ২০২০-তে ভারত টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছেও শেষপর্যন্ত আয়োজক দেশ অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার হজম করেছিল।
কলকাতা থেকে দূরত্ব ৪০ কিমি। সেই জায়গাই আপাতত ভারতীয় ক্রিকেটের পর্যটনস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে রবিবারের পর। যুব টি২০ বিশ্বকাপের প্ৰথম সংস্করণেই চ্যাম্পিয়ন ভারত। আর দেশকে বিশ্বজয়ী করার নেপথ্যে চুঁচুড়ার তিতাস সাঁধু। যার মারকাটারি স্পেল না থাকলে ভারত একপেশেভাবে পাড়ার প্রতিপক্ষ বানিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয় পেত না। ৪ ওভারে মাত্র ৬ রান দিয়ে ২ উইকেট। প্ৰথম বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে কোনও বিশ্বকাপের ফাইনালে তিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ! অবিশ্বাস্য এরকম কীর্তিরই সাক্ষী থাকল দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমের মাঠ।
আরও পড়ুন [ স্কোরশিট থেকেই প্রথম প্রেম! ভারতকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করা চুঁচুড়ার তিতাসের কাহিনী রোমাঞ্চে ঠাসা ]
শৈশব থেকেই ক্রিকেটের প্রতি প্রবল ঝোঁক। চুঁচুড়ায় রাজেন্দ্র স্মৃতি সঙ্ঘের স্টেডিয়ামে তিতাসের সময় কাটত ক্লাব পর্যায়ের ম্যাচে স্কোরবোর্ড দেখে। তিতাসেট বাবা রণদীপ সাঁধু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলছিলেন, “স্টেডিয়াম বানানো হয়েছিল পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য রাজেন্দ্র সাঁধুর স্মৃতির কথা মাথায় রেখে। তিতাসের সময় কাটত ম্যানুয়েল স্কোরবোর্ড ফলো করে। ক্লাবের ম্যাচ থাকলেই তিতাস পেন্সিল, পেন নিয়ে বসে যেত। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত স্কোরশিট। এভাবেই ক্রিকেটের সঙ্গে সখ্যতা জন্মায়। ওঁকে দেশের হয়ে যুব বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেখতে পারাটা দারুণ স্পেশ্যাল।”
রণবীরবাবু নিজে ছিলেন রাজ্য পর্যায়ের ক্রীড়াবিদ। তিতাসেরও প্রাথমিকভাবে ভালোবাসা ছিল এথলেটিক্সের প্রতি। বাবার কোচ পিনাকী কর্মকারের কাছে অনুশীলন শুরু করেছিলেন। স্কুলের স্প্রিন্ট দলের সদস্য ছিলেন। সেই সঙ্গে তিতাস একাডেমিতে ফুটবল খেলতেন। বাবার জন্যই তিতাসের শেষমেশ কেরিয়ারের গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায় ক্রিকেট।
“এথলেটিক্সের জন্য ও প্রশিক্ষণ নিত। তাই শৈশব থেকেই ও মারাত্মক ক্ষিপ্র ছিল। একাডেমিতে দাদু অহিন্দ্র কুমার সাঁধুকে নিয়ে নিয়মিত ফুটবলও খেলতে যেত তিতাস। দু-তিন বছর এভাবেই কেটে গিয়েছিল। একদিন ওঁকে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে টেনিস বল ছুঁড়তে বলেছিলাম। ওঁর থ্রো দেখেই ঠিক করে নিই ফাস্ট বোলার হওয়ার প্রশিক্ষণ দেব ওঁকে।” বলছিলেন পিতা রণদীপ সাঁধু।
২০১৯/২০ সিজনে বাংলার সম্ভাব্যদের তালিকায় রাখা হয় তিতাসকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য সেবার বাংলার হয়ে খেলতে পারেননি। পরের বছর রুমেলি ধরের নেতৃত্বে বাংলার সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক ঘটে যায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তারপরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। প্ৰথম দুই ম্যাচে উইকেট না পেয়ে যদিও বাদ পড়তে হয়েছিল।
বাবা রণবীর সাঁধু ফোনেই বলছিলেন, “ও এমনিতেই প্ৰথম থেকে দারুণ আউটসুইং করাতে পারত। আমি এবং কোচ প্রিয়ঙ্কর মুখোপাধ্যায় ওঁর রিস্ট পজিশন ঠিক করে ইনসুইং ধারালো করার কাজে মন দিই। ২০১৯/২০ সিজনেই ও বাংলার হয়ে খেলতে পারত। তবে ও কোনওভাবেই পরীক্ষা মিস করতে চাইছিল না। পরের বছরেই নেট বোলার হিসাবে তিতাস বাংলার সিনিয়র দলে যোগ দেয়। সেই সময় অনুশীলনে ওঁর বল দেখে প্রভাবিত হয়ে যান শিবশঙ্কর পাল। বেশ কিছু অনুশীলন ম্যাচে ওঁকে খেলতে বলেন শিবশঙ্কর। প্রথম সিজন সেভাবে ভালো খেলতে না পারলেও ঝুলন গোস্বামী, রুমেলি ধরদের মত সিনিয়রদের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছিল।”
গত বছর সিনিয়র মহিলা টি২০ টুর্নামেন্টে তিতাস বাংলার জার্সিতে ৫ ম্যাচে ৭ উইকেট নেন। ফাইনালে রবিবারে নামার আগে তিতাস চার উইকেট নিয়ে ফেলেছিলেন। প্ৰথম ওভারেই ফিরিয়ে দেন ইংরেজ ওপেনার লিবার্টি হোপকে। চতুর্থ ওভারে তিতাসের ইনসুইংগারে ছিটকে যায় সেরেন স্মেলের উইকেট।
মেয়ের পারফরম্যান্স ছিটকে দিয়েছে চুঁচুড়ার বাড়িতে বসে থাকা বাবাকেও। রণবীরবাবু বলছিলেন, “ওঁর সেরা অস্ত্র হল ইনসুইং বল। ও জানে ম্যাচের ঠিক কোন সময়ে সেটা ব্যবহার করতে হবে। ওঁর সঙ্গে যখনই আমাদের কথা হয়, আমাকে বলে ঝুলনের সঙ্গে ও নতুন বল শেয়ার করতে পারেনি। একবার এক ক্লাব টুর্নামেন্টে অপরাজিত ৯৪ রান করে ঝুলনের কাছ থেকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছিল। রবিবার ওঁর পারফরম্যান্সে ঝুলনও নিশ্চয় গর্বিত হবেন।”