/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/12/Sourav-Kothari-1.jpg)
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর সৌরভ কোঠারি (ছবি টুইটার)
একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক? সৌরভ কোঠারি কে? গুগলের সাহায্য না নিয়ে যদি উত্তর দিতে পারেন, জানবেন আপনার সাধারণ জ্ঞান জাতীয় গড়ের তুলনায় অন্তত দশগুণ বেশি। উত্তরটা হলো, কলকাতার সৌরভ কোঠারি আজ বিলিয়ার্ডসের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। গত অক্টোবরে লিডসে পিটার গিলক্রিস্টের মতো বিশ্ব বিলিয়ার্ডস তারকাকে হারিয়েই এই শিরোপা ছিনিয়ে এনেছেন তিনি।গতবছর অর্জুন পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।
অবশ্যই সৌরভ বিরাট কোহলি বা বাইচুং ভুটিয়া নন। ভারতবর্ষ কেন, কলকাতার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ ফিরে তাকাবেন না। অথচ মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে তিনি রীতিমত সুপারস্টার। আরও অবাক ব্যাপার হলো, তাঁর পরিবারে আরেকজন বিশ্বসেরা আছেন। তাঁর বাবা মনোজ কোঠারি, যিনি ১৯৯০ সালে বিলিয়ার্ডসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাবা-ছেলের জুটি বিরল বললে কম বলা হয়। সৌরভ-মনোজ পড়বেন ফর্মুলা ওয়ান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাবা কেকে রসবার্গ ও ছেলে নিকো রসবার্গের দলে।
গতকাল মিশরের মার্সা আলম শহরে উড়ে গেছেন সৌরভ। অংশ নিচ্ছেন আইবিএসএফ ওয়ার্ল্ড সিক্স রেড স্নুকার চ্যাম্পিয়নশিপে। বিলিয়ার্ডসে বাজিমাত করে এবার স্নুকারে রাজত্ব করতে চান তিনি। শুক্রবার কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে 'মিট দ্য প্রেস' শীর্ষক অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন নিউ আলিপুরের বছর চৌত্রিশের বাসিন্দা। কথা বললেন মন খুলে, হাসিমুখে উত্তর দিলেন প্রতিটি প্রশ্নের।
আপনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কিন্তু সৌরভকে মানুষ সেভাবে চেনেন না। খারাপ লাগে?
সত্যি বলতে, খারাপ লাগে। কিন্তু আমি এই খেলাটা খেলি শুধুমাত্র আনন্দ থেকে। একটা অনাবিল জয় পাই কিউ বোর্ডে। সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আসলে কী বলুন তো, আমি তো ওয়ান ডে ওয়ান্ডার। এরপর আর কেউ মনে রাখে না। কাগজে লেখালেখি হয়, তারপর মানুষ ভুলে যায়। একটা হতাশা থাকেই। কিন্তু এই খেলা থেকেই আমি গুরুত্ব পেয়েছি। কিছু মানুষ শুভেচ্ছা আর ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন।
বিলিয়ার্ড বলুন বা স্নুকার, এদেশে গ্রহণযোগ্যতা কেন পেল না? সমস্যা কোথায়?
প্রথমেই বলব খরচের কথা। কলকাতায় খেলাটা হাতে গোনা কিছু নামী ক্লাবেই খেলা হয়। যেখানে ২০-২৫ লক্ষ টাকা লাগে মেম্বারশিপ নিতে। সাধারণ মানুষ পারবেন এত টাকা দিতে? কলকাতায় তো খেলার কোনও জায়গাই নেই। যে পার্লারগুলো আছে, সেখানে বোর্ডের অবস্থা দেখলে করুণা হয়। অথচ হায়দরাবাদ, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে রমরমিয়ে চলছে খেলা। জানেন, ফেসবুকে প্রচুর বাবা-মা মেসেজ করেন, তাঁরা সন্তানদের খেলাটা শেখাতে চান। কিন্তু আমি কোনও উত্তর দিতে পারি না। আগে একটা সময় ইএসপিএন-এ নিয়ম করে এই খেলা দেখানো হতো। কেন জানি না, এখন আর দেখানো হয় না। টেলিভিশনেরও একটা ভূমিকা রয়েছে এই খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে।
ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে কি এই খেলার কোনও পরিকাঠামো গড়ে উঠতে পারে?
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমার বাবার সঙ্গে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কথা হয়েছে। কলকাতায় একটা কিউ স্পোর্টস অ্যাকাডেমির কথা বলেছেন উনি। আমি মিশর থেকে ফিরে আসি, তারপর অরূপবাবুর সঙ্গে বসে কথা বলতে চাই। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠোরের সঙ্গেও আমার একটা বৈঠকের কথা রয়েছে। সেটা কলকাতাতেও হতে পারে বা অন্য কোথাও। শুধু ওঁর একটা ফোনে আমাদের সল্টলেকে কিউ স্পোর্টসের পরিকাঠামো তৈরি হয়ে যাবে। পাঁচ-সাতটা বোর্ড পেলেই শুরু করে দেওয়া যায়। ভারতের বাইরে এই খেলা কতটা জনপ্রিয় ভাবতেও পারবেন না। ওখানে খেলোয়াড়রা ফ্যানদের ভয়ে রাস্তায় বেরোতে পারেন না।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/12/Sourav-Kothari.jpg)
কিউ স্পোর্টস অলিম্পিকের অন্তর্ভুক্ত নয় বলেই কি জনপ্রিয়তা পায়নি?
আমরা এটা ভুলে যাই যে, অলিম্পিকের বাইরেও অনেক খেলা রয়েছে যেগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। যেমন কিউ স্পোর্টস (কিউ অর্থাৎ সেই লম্বা সরু লাঠি, যা দিয়ে বিলিয়ার্ডস এবং স্নুকার খেলা হয়)। আমি খেলি বলে বলছি না। এরকম অনেক স্পোর্টস আছে যেগুলো মূলস্রোতের স্পোর্টসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কিউ স্পোর্টস ইউরোপ ও বিশ্বের অনান্য প্রান্তে আজ অসম্ভব জনপ্রিয়। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানেও কিন্তু চিত্রটা চমকে দেওয়ার মতো। আমাদের দেশে মানুষের অলিম্পিক স্পোর্টস নিয়ে একটা পাগলামি রয়েছে। আশা করছি প্যারিসে ২০২৪ অলিম্পিকে কিউ স্পোর্টস থাকবে। ২০২০ টোকিও-তে হয়নি। আশা করছি বিশ্ব কনফেডারেশন দরপত্র জমা দেবে।
কিউ স্পোর্টসের খেলোয়াড়দের এখানে কোন চোখে দেখা হয়?
আমাদের সমাজে এখনও এরকম খেলাকে কেউ সিরিয়াসলি নেন না। এখনও মনে আছে, আমি বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে শুনতাম, "আচ্ছা আপনি খেলেন, আর কী করেন?" যেন খেলাটা কোনও ব্যাপারই নয়। বাবা-মায়েরা সন্তানের সামনে টার্গেট সেট করে দেন, তাদের বলা হয়, তিন-চার বছরের মধ্যে কিছু করতে না পারলে আবার সেই গতানুগতিক জীবনে ফিরতে হবে। এরকম চাপে কেউ পারফর্ম করতে পারে না। এভাবে আমরা ট্যালেন্ট হারিয়ে ফেলছি। আমাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে কুড়িটা বছর সময় দিতে হয়েছে। একবারে সফল হতে পারেনি। সবারই সময় লাগে। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, আমার বাবা আমাকে এভাবে সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছেন। শুধু বলেছেন, খেলে যেতে। বাকি সব তিনি দেখে নেবেন। কিন্ত ক’জন এরকম সাপোর্ট পায়? ফলে "আর কী করেন?" প্রশ্নটা আমার মনোবলে আঘাত করতে পারেনি।
জাতীয় ফেডারেশন খেলাটাকে জনপ্রিয় করতে কতটা সক্রিয়?
ফেডারেশন চেষ্টা করছে তাদের মতো। কিন্তু আমি বলব বিসিসিআই সবার মডেল হওয়া উচিত। ওরা ক্রিকেটের সংজ্ঞাটা বদলে দিয়েছে। খেলার মার্কেটিংটাই করেছে অন্যভাবে। আজ বিসিসিআই-এর জন্যই ক্রিকেট এই জায়গায়। একবারও বলব না, কিউ স্পোর্টস ভিউয়ার ফ্রেন্ডলি নয়, কিন্ত এখানেও বানিজ্যকরণের অনেক রাস্তা রয়েছে। আসলে বিনোদন ছাড়া কোনও খেলা এখনকার দিনে টিকে থাকতে পারবে না। এই কারণেই টেস্ট ক্রিকেট ধুঁকছে। মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাই আসল।
ভারতীয় স্পোর্টসে পাবলিক সেক্টরের ভূমিকা ঠিক কতটা?
পাবলিক সেক্টর এখন ভারতীয় স্পোর্টসের মেরুদণ্ড। এটা কোট লিখে নিন। দেশের প্রথম সারির প্রতিটি অ্যাথলিটকে সমর্থন করছে তারা। ওএনজিসি বলুন বা ইন্ডিয়ান ওয়েল। দুরন্ত কাজ করছে। স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, অফিসে আসতে হবে না। মন দিয়ে যেন সবাই খেলাটা চালিয়ে যায়। এর ফলে ব্রেড অ্যান্ড বাটারের কথা ভাবতে হয় না। চিন্তা করতে হয় না বিদেশ সফরের টাকা কোথা থেকে আসবে। কিন্তু তাও, ওদের সমর্থন পেতে গেলে নিজের ফিল্ডে একটা ছাপ ফেলতে হবে। সবচেয়ে ভাল হতো যদি উঠতি প্লেয়ারদের পাশে ওরা দাঁড়াত। তাদের অনেকটা লড়াই করতে হয়।
স্নুকার আর বিলিয়ার্ডসকে অনেকেই একই খেলা মনে করেন, ফারাকটা ঠিক কতটা?
বোর্ড আর কিউ স্টিক ছাড়া কোনও মিল নেই। স্নুকার একেবারে টেক্সটবুক মেনে। দাঁড়ানো থেকে শট নেওয়া, সবটাই মাপা। অন্যদিকে বিলিয়ার্ডসে অনেক স্বাধীনতা রয়েছে। টেকনিকে পরিবর্তন আনা হয়। আমি বিলিয়ার্ডস আর স্নুকার দুটোই খেলি। এরকম খুব কম খেলোয়াড় রয়েছেন। একসময় সিক্স রেড স্নুকারে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিলিয়ার্ডসে বেশি ফোকাস করায় স্নুকারে সমস্যা হচ্ছিল। আজও প্র্যাকটিসের সময় সেটা টের পেয়েছি। কিন্তু বাবার গাইডেন্সে সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আশা করছি মিশরে সেটা কাজে লাগাতে পারব।
মিশরে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীতা কাদের সঙ্গে?
চিন, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, মিশর রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোও ভীষণ শক্তিশালী। এবার ভারতের হয়ে টিম ইভেন্টে চারটে দল অংশ নেবে। আমি কিন্তু টিম ইভেন্টে খেলছি না। দেশের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ব্যক্তিগত ইভেন্টে অংশ নিচ্ছি।
কিউ স্পোর্টসের ওপর তথ্যচিত্র নিয়ে কথা চলছিল? সেটার কী হলো?
আমি কিউ স্পোর্টসের ওপর একটা ডকুমেন্ট্রি করতে চাই। টলিউড ও বলিউডের পরিচালকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। দেখা যাক। টম ক্রুজের 'দ্য কালার অফ মানি' ছবিটাও ছিল এই খেলা নিয়ে। দেখা যাক কী হয়। বায়োপিক হলেও সমস্যা নেই। বলিউডি মশালা ছবিও হতে পারে। যাতে বিনোদনের সব উপাদান থাকবে।
বায়োপিকে কাকে দেখতে চাইবেন?
বাংলার কেউ হলে আবির চট্টোপাধ্যায় হতে পারেন। যদিও ওঁকে চশমা পরা ব্যোমকেশ বক্সী লুকটা ভাল মানায়। কিন্তু দেখবেন, যেই করবে, সে যেন আমার মতোই অবিবাহিত হয়। হিন্দিতে হলে অবশ্যই রণবীর কাপুর। ওর মধ্যে ভীষণরকম সেই ব্যাপারটা রয়েছে, যে কোনও চরিত্রে মানিয়ে যেতে পারে।