তাঁর বাঁকানো লেট ইয়র্কার টনি দি জর্জির প্যাডে আছড়ে পড়তেই উল্লাস শুরু করতে শুরু করে দিলেন অর্শদীপ সিং। তবে আম্পায়ার সরাসরি আউটের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। চরম নাটকীয়তার সঙ্গে অর্শদীপ সঙ্গেসঙ্গে ক্যাপ্টেন কেএল রাহুলকে রিভিউয়ের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। দোনোমনো করে ক্যাপ্টেন রিভিউয়ের জন্য আবেদন করতেই কেল্লাফতে। গোটা দলই লাগামছাড়া উচ্ছ্বাসে মেতে উঠল।
ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট যেন ওটাই। ম্যাচ শেষ হল ভারতের ৭৮ রানের জয়ে। সিরিজ পকেটে পুরে। দক্ষিণ আফ্রিকা বড়সড় টার্গেটের সামনে একদম ডিপ পর্যন্ত ব্যাট করল। তবে ভারতকে সবথেকে চিন্তায় রেখেছিলেন ওপেনার টনি দি জর্জি। গত ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ন দি জর্জি যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন ততক্ষণ জয়ের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। মিলার নয়, জর্জির ব্যাট-ই যেন ভারত এবং সিরিজ জয়ের মধ্যে ফারাক হয়ে উঠেছিল পার্লের বোল্যান্ড স্টেডিয়ামে।
স্লো পিচ। স্ট্রোক প্লেয়ারদের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর উপত্যকা এই পিচ। এই পিচেই ভারত ২৯৭ তুলে দিয়েছিল স্কোরবোর্ডে। প্রায় তিনশো রান চেজ করতে নেমেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন টনি দি জর্জি। প্রায় ৩০ ওভার পর্যন্ত প্রোটিয়াজ ওপেনার ভারতকে ব্যাকফুটে ঠেলে রেখেছিল। অক্ষর প্যাটেল, হোক বা আবেশ খান কাউকেই রেয়াত করছিলেন না। অক্ষর প্যাটেলকে সুইপ করার ছক্কা হাঁকাছিলেন চরম ঔদ্ধত্বের সঙ্গে। ম্যাচ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছিল ভারতের নাগাল থেকে।
তবে এমন একটা ডেলিভারিতে অর্শদীপ ভারতের ত্রাস হয়ে ওঠা ব্যাটারকে ফেরালেন যা সাধারণত মিডল ওভারে তিনি করেন না। সেই লো ফুল টসেই শেষমেশ ম্যাচের ভাগ্য লিখে দিল। এই সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকা হারলেও তাঁদের প্রাপ্তি টনি দি জর্জির ব্যাটিং। আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিদের নির্ঘাত নজরে চলে এসেছেন তিনি। আইপিএলে ব্লকবাস্টার হওয়ার যাবতীয় উপকরণ মজুত রয়েছে তাঁর ব্যাটে- নির্ভীক ব্যাটিং, দুর্ধর্ষ সমস্ত স্ট্রোকের সম্ভার, ক্লিন স্ট্রাইকিং, স্পিনারদের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ ফুটওয়ার্ক।
সেন্ট জর্জিস পার্কের মত দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনাররা দাপট দেখিয়ে গেলেন নতুন বলে ভারতীয় সিমারদের সামনে। লাইন-লেন্থে সামান্যতম ভুলেই মিলছিল শাস্তি। রেজা হেন্ড্রিক্স।এবং দি জর্জি দুজনেই প্ৰথম ৮ ওভারে ৫৫ তুলে দেন। এরমধ্যে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছিলেন দি জর্জি। মুকেশ কুমারকে টার্গেট করেছিলেন। অর্শদীপ রেজা হেন্ড্রিক্সকে দুর্ধর্ষ ডেলিভারিতে আউট করার আগে পর্যন্ত রান তোলার গতি আটকাতে পারেননি।
ভারতীয় ব্যাটাররা বোল্যান্ড পার্কের পিচে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। টনি ডি জর্জি বাদে প্রোটিয়াজ ব্যাটাররাও সেই অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। স্ট্রোক মেকার রাসি ভ্যান দার দুসেন ২ রান করতে নিয়ে নেন ১৭ বল। তাঁর কষ্ট করে ক্রিজে থাকার লড়াই থামিয়ে দেন অক্ষর প্যাটেল। স্লাইডারে। এমন পিচেই ভারতের সামনে আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন দি জর্জি। স্লো পিচেই ভারত বরাবর অপ্রতিরোধ্য। তবু ভারতের স্পিনারদের ওপর দাদাগিরি করে গেলেন প্রোটিয়াজ ওপেনার।
তবে যতবার-ই দক্ষিণ আফ্রিকা রান চেজ করার সময় ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছিল, ততবার-ই উইকেট হারাতে হচ্ছিল। দুসেন না পারলেও ক্যাপ্টেন আইডেন মারক্রাম পিচের গতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে দলকে টানছিলেন। তবে ওয়াশিংটন সুন্দরকে রিভার্স প্যাডেল সুইপ হাঁকাতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেন।
উইকেটকিপার হিসাবে দারুণ খেললেন ক্যাপ্টেন রাহুল। মিলারকে দুর্ধর্ষ ক্ষিপ্রতায় তালুবন্দি করলেন। একইভাবে হেনরিখ ক্ল্যাসেন এবং ডেভিড মিলার যখন ছন্দে ব্যাটিং করতে শুরু করলেন, তখনই উইকেট হারাতে হল। আবেশ খানের আগের বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন। পরের বল প্রত্যাশার থেকেও বেশি বাউন্স আদায় করে নিল। ব্যাটের কানায় লেগে হওয়ায় উড়তেই দুরন্তভাবে ক্যাচ তালুবন্দি করলেন সাই সুদর্শন।
এরপরে শেষ দিকে আরও একবার ব্যাটিং বিপর্যয়। ১৬ রান যোগ করার ফাঁকে আরও তিন উইকেট হারায় প্রোটিয়াজরা। এরপরে ভারতের সিরিজ জয় আর আটকানো যায়নি।
তার আগে ভারত প্ৰথমে ব্যাটিং করে সঞ্জু স্যামসন এবং তিলক ভার্মার ব্যাটে ২৯৬ তুলেছিল স্কোরবোর্ডে। সঞ্জু টিম ইন্ডিয়ার জার্সিতে ওয়ানডেতে প্ৰথম শতরান হাঁকান। প্ৰথম কেরালা ব্যাটসম্যান হিসাবেও আন্তর্জাতিক স্তরে প্ৰথম সেঞ্চুরি করে যান তিনি। ভারত স্কোরবোর্ডে ১০১ তোলার ফাঁকেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল। সেই সময়েই তিলক ভার্মাকে সঙ্গে নিয়ে সঞ্জু স্যামসন ১১৬ রানের পার্টনারশিপ গড়ে বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। এমনিতে সঞ্জু স্ট্রোক প্লেয়ার হলেও চ্যালেঞ্জিং কন্ডিশনে নিজের সহজাত প্রবৃত্তিকে ঢেকে সংযত ইনিংস খেলে যান। ফিফটি করেন ৬৬ বলে।1
নিজের ইনিংসে মাঝেমধ্যে টি২০ অবতারের ঝলক দেখালেও সঞ্জু আগাগোড়াই নিজের স্বভাবজাত স্ট্রোক প্লেকে গুটিয়ে রাখলেন সময়ের দাবিতে। তিলক ভার্মাও সেভাবে মসৃণ ছন্দে খেলতে পারছিলেন না। প্ৰথম বাউন্ডারি হাঁকাতে সময় নেন ৩৯ বল। শেষ পর্যন্ত রান তোলার গতি বাড়াতে গিয়ে মহারাজের বলে মিস টাইম করে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন।
তিলক আউট হয়ে গেলেও ভারতের ইনিংস টানতে থাকেন সঞ্জু। মহারাজের বলে লং অফে সিঙ্গলস নিয়ে নিজের শতরান পূরণ করেন। এরপরে লিজার্ড উইলিয়ামসকে হাঁকাতে গিয়ে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসেন তিনি। শেষদিকে, রিঙ্কু সিংয়ের ক্যামিও (২৭ বলে ৩৮) ভারতের স্কোর তিনশোর কাছে টেনে দেন।