Advertisment

একটাই ম্যাচ হেরেছে ভারত, তাতে কী হয়েছে?

এই ম্যাচে কিন্তু একটা বাঙালি সেন্টিমেন্ট কাজ করে। ভাষাটাও এক। খাদ্যাভাসও এক। ভারতীয় হিসেবে চাইব ভারত জিতুক। কিন্ত হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচই চাইব। 

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
reason-behind-indias-semifinal-loss-againgst-newzeland

কেন হারল ভারত, কী বলছেন শরদিন্দু মুখোপাধ্য়ায়!

চলতি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম হার হজম করতে হয়েছে ভারতকে। তার পরেই বিরাট কোহলি অ্যান্ড কোং-এর সমালোচনায় সরব হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একাংশ। তবে এক ম্যাচ হারার পরেই টিম ইন্ডিয়াকে নিয়ে এইভাবে পোস্টমর্টেম করাটা মেনে নিতে পারছেন না ভারতের আরেক প্রাক্তন ক্রিকেটার। তিনি শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার বিশ্বকাপ বিশেষজ্ঞ। আর কয়েকঘণ্টা পরেই ফের এজবাস্টনে বাংলাদেশের মুখোমুখি হবে ভারত। কিন্তু এই ম্যাচের প্রিভিউ করতে গিয়ে শরদিন্দু বারবার ফিরে গিয়েছেন ভারত বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচে।

Advertisment

ভারতের মন্থর শুরু এবং শেষ। টুর্নামেন্টের শেষ ভাগে কতটা ভোগাবে?

দু'রকম ভাবে জিনিসটা দেখা যায়। ভারত যদি টসে জিতে ব্যাটিং করে, তাহলে কখনোই মন্থর শুরু হবে না। কারণ ভারত চাপমুক্ত হয়ে ব্যাট করবে। ভারতের মন্থর শুরুটা তখনই হচ্ছে যখন শুরুতে উইকেট পড়ছে। ভুলে গেলে চলবে না, ভারতের প্রথম তিন ব্যাটসম্যান - রোহিত শর্মা, কেএল রাহুল এবং বিরাট কোহলি - স্ট্রোক প্লেয়ার। ফলে মন্থর শুরু হবে না। তখনই ধীর গতিতে শুরুটা হয় যখন ভারত রান তাড়া করতে নামে এবং রোহিত শর্মার মতো ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যান। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শুরুতেই ভারত রাহুলের উইকেটটা হারিয়েছিল। প্রথম দিকে রোহিত সেরকম টাইমিং করতে পারছিলেন না, যেটা আমরা দেখে অভ্যস্ত। ফলে চাপটা বাড়ছিল কোহলির ওপর। কিন্তু তারপর রোহিত-কোহলির একটা দুর্দান্ত ১৩৮ রানের পার্টনারশিপ হয়েছিল।

কোহলি আউট হওয়ার পরই খেলাটা মন্থর হতে শুরু করেছিল। কারণ তখনই আস্কিং রেটটা বাড়তে শুরু করে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঋষভ পন্থকে চার নম্বরে নামিয়েই ভারত সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে। ও চার নম্বরের প্লেয়ার নয়, ওখানে কেদার যাদবকে পাঠানো উচিত ছিল। কেদারকে সাতে পাঠিয়ে কোনও লাভই হবে না। যখন ১৪ করে ওভার পিছু রান প্রয়োজন, তখন কিন্তু কেদার কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু পন্থ ১৪ করতে পারবে। ইংল্যান্ডের মতো একটা টিমের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ পন্থকে খেলাচ্ছি। ৩৩৭ রান তাড়া করতে বলে ওর থেকে তো প্রত্যাশা করতে পারি না। একটা উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে। তবুও রান তো করেছে। আমার কথা হলো, কেদারকে কী করতে রেখেছি! কেদারকে চারে নামিয়ে ধোনিকে পাঁচে, আর পন্থকে ছয় নম্বরে খেলানো উচিত ছিল। একটা সময় পন্থ আর হার্দিক পাণ্ডিয়া রানটা ১০-এর নিচে নামিয়ে এনেছিল।

ভারত বারবার চার নম্বর সিলেকশনটা ভুল করছে। যেখানে কেদারকে খেলানোর কথা সেখানে পন্থকে নামিয়ে দিচ্ছে। ভারতের দু'টো ম্যাচ রয়েছে সামনে। একটা ভারত জিতবেই। লিগ টেবিলে দুই কিম্বা তিনে শেষ করবে। সেক্ষেত্রে সম্ভবত ভারত-নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনাল খেলবে। অস্ট্রেলিয়া আরেকটা ম্যাচ জিতে এক নম্বরে শেষ করবেই। ইংল্যান্ডকে চারে আসতে গেলে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে হবে। ভারত দু'টো ম্যাচে ব্যাটিং সেট করে নেবে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই চারে দীনেশ কার্তিক বা কেদার যাদব খেলবে। পাঁচে ধোনি, ছয়ে পন্থ আর সাতে নামবে পাণ্ডিয়া। পন্থ এসে যাওয়ায় ৪৫-৫০ ওভারে ভারতের একটা মারাত্মক কম্বিনেশন তৈরি হয়ে গিয়েছে।

অনেকেই বলছেন ভারত অন্তত লড়াই করে অল আউট হলেও পারত। কীভাবে দেখছেন বিষয়টা?

গত ম্যাচের পর অনেক পণ্ডিত বলেছেন যে, ভারতের রান তাড়া করার ধরণ দেখে তাঁরা বিব্রত। কিন্তু একটা জিনিস ভুলে গেছেন তাঁরা, ভারত যখন বুঝে গিয়েছিল ৩৩৭ তাড়া করা সম্ভব নয়, তখন আর উইকেট হারাতে চায় নি। আরে দিনের শেষে রানরেটের কথা তো ভাবতে হবে। রানরেট ঠিক থাকলে দুই থেকে তিন নম্বর জায়গায় শেষ করাটা নিশ্চিত। একটা সময় বোঝা যায় যে, ম্যাচ আর হাতের মধ্যে নেই। জেতা যাবে না, ১৪-১৫ স্ট্রাইক রেট তোলা সম্ভব নয়। তখন যদি ৩০০ পেরিয়ে যাই আর হাতে উইকেট থাকে, তাহলে কেন উইকেট হারাব? আগে তো যোগ্যতা অর্জন করব, তারপর নাহয় লোককে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করব!

২৮০ করে অলআউট হয়ে যাওয়া আর হাতে পাঁচ উইকেট নিয়ে ৩০০ রানে থামার মধ্যে তো একটা পার্থক্য আছে। এটা বুঝতে হবে। আমি প্লাস রানরেটে থেকে প্লাস রানরেটেই শেষ করেছি। একটা ম্যাচ হেরে কেন এত লাফালাফি করছি আমরা? পরপর জিতে একটা হেরে কী ক্ষতিটা হয়েছে! দু'নম্বরেই তো শেষ করেছি। অস্ট্রেলিয়ার নেট রানরেট ১, আর ভারতের ০.৮৫৪। মানে দু 'নম্বরে রয়েছি আমরা। অস্ট্রেলিয়ার থেকে পয়েন্ট ১৪ পিছনে রয়েছি। আমি তাহলে কী খারাপ বুদ্ধিটা লাগিয়েছি? তাও ইংল্যান্ডের মতো দল। যারা কয়েকদিন আগেও এক নম্বরে ছিল। তাদের বিরুদ্ধে হারলাম, তাও টানা জিতে আসার পর।

সবাই হেরেছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কেউ বাদ যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে তো ছিটকেই গিয়েছে। পাকিস্তানও হেরেছে। এই ম্যাচটাকে 'ওয়েক আপ কল' হিসেবে কেন নিচ্ছি না! লিগে একটা ম্যাচ হেরে পর্যালোচনায় বসতে হবে। ২০ ওভারে ১৫৮ রান দিয়ে একটা উইকেট পেয়েছি। মাঝখানে স্পিনারদের ব্যর্থতা রয়েছে। দেখতে গেলে কুলদীপ আর চাহালকে তো অনেকেই দেখে নিয়েছে, খেলেছে। আর এটা তো লিগ পর্যায় ঘটেছে। ফলে সময় থাকছে ব্যাটিং-বোলিং সবটা খতিয়ে দেখার। এটা নকআউটে হলে তো ছিটকেই যেতাম। তাহলে এত কথা বলার কী প্রয়োজন!

একটা ম্যাচ জিতলে তো একশ শতাংশ কোয়ালিফাই করে যাব। এখনই কোয়ালিফাই করে গেছি। ৩৩৭ রান তাড়া করতে গিয়ে দশবারের মধ্যে ন'বার একটা দল হারবে। আরে যারা বিপক্ষে খেলছে তাদের কাছে ডু-অর-ডাই ম্যাচ ছিল এটা। হেরে গেলেই তারা ছিটকে যেত, আজ ভারত ওই জায়গায় থাকলে, কী দৃষ্টিভঙ্গি হতো? সেটা কেউ ভাবছে না, তাদেরও তো প্রশংসা প্রাপ্য।

ডিসিপ্লিনড পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে স্লো উইকেটে কি খেই হারিয়ে ফেলে ভারত?

একথা একেবারেই আমি বিশ্বাস করি না। ১৩৮ রানের পার্টনারশিপই হতো না। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা এখন পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ। আইপিএলের সৌজন্যে বিশ্বের তাবড় পেসারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করছে ভারতীয়রা। প্র্যাকটিসে খেলে শর্ট বলের ভীতি চলে গেছে। আজ যখন দেখি রোহিত-বিরাটরা পেস বোলারদের সামনের পায়ে পুল মারছেন, তখন গর্বে বুক ভরে যায়।

ইংল্যান্ডের ডিসিপ্লিনড পেস বোলিংয়ের ক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হবে। ইংল্যান্ড কিন্তু নিজেদের দেশের মাটিতে খেলছে। ওরা মাঠগুলো হাতের তালুর মতো চেনে। শর্ট বলগুলো করেছে মাঠের বড় দিকটায়। পুল আর হুক মারার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারতীয়দের। কিন্তু ভারত সেই ফাঁদে পা দেয় নি। কেউ কিন্তু পুল বা হুক মেরে আউট হয়নি। পন্থ আউট হয়েছে শেষের দিকে, তাও মাঠের ছোট দিকে মেরে। ওদের জোরে বোলার যাঁরা রয়েছেন, জোফ্রা আর্চার, মার্ক উড, ক্রিস ওকস, লিয়াম প্লানকেটরা মাঝ পিচে বল করছেন, স্লো বলগুলো করছেন বড় দিকে মারার জন্য। ভারত কিন্তু ৩১ রানে হেরেছে। গোহারা হারে নি। অস্ট্রেলিয়ার পর ইংল্যান্ডের পেস বোলিং সবচেয়ে ভাল। তাদের বিরুদ্ধে যদি ৩০৫ রানে শেষ করতে পারি, তাহলে আমরা ভাল ব্যাট করেছি।

আমরা অল আউট হই নি, হতে চাই নি, নেট রানরেটের কথা ভেবেই। এটাই আমাদের নীতি ছিল। তাহলে কিন্তু ধোনি অনেক আগে থেকেই মারতে শুরু করতে পারতেন। পন্থ-পাণ্ডিয়াও সেই পথে হাঁটেন নি। আমি তো বুঝতে পারছি না, বাকিরা এই রানরেটের কথা কেন বলছেন না। তাঁরা প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার, তাঁরা কিংবদন্তি, তাঁদের মাথায় কি একবারও এই বিষয়টা এল না?

ইংল্যান্ডের মাঠগুলোর আকার আয়তন কতটা প্রভাবিত করে খেলার গতি?  

এখন মাঠটা দু'দিন আগেই দলের কাছে চলে যায়, তখন সব বিষয়গুলো দেখে নেওয়া যায়, ফলে এগুলো নিয়ে কোনও চিন্তার বিষয় নেই। এজবাস্টনের ছোট বাউন্ডারি নিয়ে বিরাট কোহলি প্রশ্ন তুলেছেন। শুনে চমকে গিয়েছি। আরে বাবা, একই মাঠে তো দু'টো টিমই খেলছে। ইংল্যান্ড ছোট বাউন্ডারির পুরো ফায়দা তুলতে পেরেছে। ভারত পারে নি। কৃতিত্ব অবশ্যই ইংল্যান্ডের। একটা দলের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। ওরা জেতার জন্য মরিয়া। কী সুন্দর পরিকল্পনাগুলোকে কাজে লাগিয়েছে, সেটার কথা বলতেই হবে। আজ ভারত এরকম পারফরম্যান্স দিলে আমরা তো প্রশংসায় ভরিয়ে দিতাম। ইংল্যান্ডের ভাল খেলার কথা বলব না! ভারতের ফ্যান হিসেবে চাইব ভারত সব ম্যাচ জিতুক। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে প্রায় সব সিনিয়র প্লেয়ার কমবেশি চোটে ভুগছেন। এতে দলের মনোবল বাড়ে না কমে?

এরকম লম্বা টুর্নামেন্টে চোট-আঘাত থাকেই। এটাকে 'নিগল' বলে। এটা নিয়েই চলতে হয়। একশ শতাংশ ফিট কেউ থাকতে পারে না। আমরা যখন খেলতাম তখনও এসব চোট-আঘাত নিয়েই খেলতাম। পুরোপুরি ফিট থাকতাম না। এটা খেলারই অঙ্গ। ব্যথা-চোট থাকতই। ফিজিও, ওষুধ এগুলো খেয়েই ঠিক থাকতাম। কেউ বলতে পারবে না সে পুরো ফিট। এগুলোর সঙ্গে লড়াই করার জন্য ফিজিও রয়েছেন, ট্রেনার, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচের অপেক্ষায় রয়েছি। শেষ একটা বছর ওরা ওয়ান-ডে ক্রিকেটটা দুরন্ত খেলছে। আমি বলব উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানকে ধরে ফেলেছে বাংলাদেশ। ওরা আজ ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই ম্যাচে কিন্তু একটা বাঙালি সেন্টিমেন্ট কাজ করে। ভাষাটাও এক। খাদ্যাভাসও এক। ভারতীয় হিসেবে চাইব ভারত জিতুক। কিন্ত হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচই চাইব। 

শেষ চারে যাওয়ার আশা নেই, তবু বাংলাদেশের মোটিভেশন কী?

অনেকগুলো প্লাস পয়েন্ট রয়েছে। শাকিব আল হাসান শেষ দু'তিন বছর ধরে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। তিন নম্বর জায়গায় ব্যাট করে নিজেকে একটা অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন নিজেকে। চলতি বিশ্বকাপেও দারুণ ফর্মে রয়েছেন উনি। ডেভিড ওয়ার্নার (৫১৬), অ্যারন ফিঞ্চের (৫০৪) পর তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক শাকিব (৪৭৬)। অনান্য প্লেয়ারদের মধ্যে লিটন দাস, সৌম্য সরকার, তামিম ইকবালরাও আরও দু'তিনটি বিশ্বকাপ খেলবেন। দেখতে গেলে দলটা তরুণ। মাশরাফি মোর্তাজা আর খেলবেন না। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে ওঁকে দেখে অধিনায়ক বলেই মনে হচ্ছে না। গোটা বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত একটা উইকেট নিয়েছেন। আমার মনে হয় মোর্তাজা তিনে বল করুন। সইফুদ্দিন আর মুস্তাফিজুর খেলুন। মোর্তাজার বল সুইং করছে না, গতি কমে গিয়েছে। পাঁচবার হাঁটুতে অস্ত্রোপচারও হয়েছে। এর ফলে ওপেনাররা সেট হয়ে যাচ্ছে।

India Bangladesh Cricket World Cup
Advertisment