দেখতে গেলে, 'চ্যানেল নাইন অস্ট্রেলিয়ার' মালিক কেরি প্যাকারের মস্তিষ্কপ্রসূত গোলাপি বলের ক্রিকেট। রঙিন পোশাকে ফ্লাডলাইটের আলোয় রাতের বেলার ক্রিকেট প্রথম খেলা হয় আশির দশকে, যদিও বলের রঙ ছিল সাদা। সারা বিশ্বে আপামর ক্রিকেটপ্রেমির মনে সাড়া জাগিয়ে বাইশ গজে এক বিরাট আন্দোলন আনে ক্রিকেটের এই নতুন অবতার। এর আগে কেউ ভাবেন নি যে, বলের রঙ লাল, বা পোশাকের রঙ সাদা ছাড়া আর কিছু হতে পারে।
আইসিসি যেভাবে গোলাপি বলে সায় দিল
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) প্রথমে গোলাপি বলের ক্রিকেটে অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু বিশ্বের তাবড় ক্রিকেটাররা প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলায় মাঠে ভিড় উপচে পড়েছিল। জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। পরে অবশ্য আইসিসি বিষয়টা প্রগতিশীল বুঝে বিভিন্ন দেশের মধ্যে দিবা-রাত্রের ম্যাচের আয়োজন করে। ওয়ান-ডে ক্রিকেটে রঙিন পোশাক ও কালো স্ক্রিনের জন্য সাদা বল ব্যবহার করা হয়। ২০১০ থেকে গোলাপি বলের ব্যবহার চলছে। টেস্ট ক্রিকেটের সাদা পোশাক ও ফ্লাডলাইটের দৃশ্যমানতার সঙ্গে এই বল মানানসই।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে 'গোলাপি' ইতিহাসে ভারত
আগামীকাল ভারতে এই প্রথমবার ইতিহাস রচিত হচ্ছে ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন গার্ডেন্সে। এর জন্য সর্বতোভাবে ধন্যবাদ জানাতে হবে বিসিসিআইয়ের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। বাংলাদেশ যখন ভারত সফরে একটা টি-২০ টিম দল পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সৌরভ বাংলাদেশকে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটা গোলাপি বলে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন। তাও আবার নান্দনিক ইডেনে। অনেক টানাপোড়েন ও বেশ কিছু মিটিংয়ের পর বাংলাদেশ সবুজ সঙ্কেত দিল।
কতদিন চলবে ইডেনের 'গোলাপি বল টেস্ট'
ইন্দোরে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশকে তিন দিনে শেষ করে দিয়েছে ভারত। যদিও লাল বলে খেলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গোলাপি বলে ইডেনে কতদিন চলবে এই দিন-রাতের ম্যাচ। সবার মুখে এখন এই একটাই প্রশ্ন। আমরা জানি গোলাপি বল বেশি সুইং করে। বলের ওপর বেশি 'ল্যাকার' থাকার জন্য় এমনটা হয়। এক সাক্ষাৎকারে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি একথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন।
গোধূলি বেলায় যখন হাওয়া দেয় ও একটু আর্দ্রতা পাওয়া যায়, এই পরিবেশে গোলাপি বল মারাত্মক সুইং করে। দেখা যায় 'ল্যাটারাল মুভেমেন্ট' বা পার্শ্বীয় আন্দোলন। অনেক টিম দিনের আলোয় ব্যাটিং করে ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। গোধূলি বেলায় সুইং আর সিমের সুবিধা নিয়ে দ্রুত উইকেট তুলে নিয়েছে। ব্যাটসম্যানদের খুব একটা প্রিয় নয় এই গোলাপি বলের ক্রিকেট, বলাই বাহুল্য। কোনও সময়ই তাঁরা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না (সেট হয়ে গেলেও)। বোলারদের, মূলত জোরে বোলারদের স্বপ্নের হাতিয়ার এই গোলাপি বল। ইডেনের উইকেট থাকবে ব্যাটিং সহায়ক। ভারত প্রথমে ব্যাট করলে খেলা চতুর্থ দিন পর্যন্ত গড়াবে। নাহলে তিনদিনের বেশি গড়াবে না।
চার বছর আগে ইতিহাস লিখেছিল অস্ট্রেলিয়া
আইসিসি-র অনুমোদন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম গোলাপি বলের ম্যাচ খেলে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। অ্যাডিলেড ওভালে ২০১৫-র ২৭ নভেম্বর বাইশ গজে প্রথম দিন-রাতের টেস্ট খেলে ইতিহাস লেখে দুই দল। টেস্ট ম্যাচের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ও দর্শকদের মাঠে টেনে আনতে দিবা-রাত্রির পিঙ্ক বল ক্রিকেটের সূচনা। মোট তিন দিন ধরে অ্যাডিলেডে খেলা উপভোগ করেছিলেন ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৭৩৬ জন দর্শক। এরপর পাকিস্তান খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুবাইয়ে। অস্ট্রেলিয়া খেলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অ্যাডিলেডে। ফের ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়া খেলে পাকিস্তানের সঙ্গে।
গোলাপি টেস্টের জন্য সাজছে কলকাতা
সাজ সাজ রবে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে সৌরভের নেতৃত্বে চলছে কাজ। সেজে উঠতে শুরু করেছে ইডেন। চলে এসেছে ম্যাচের দুই ম্যাসকট পিঙ্কু ও টিঙ্কু। ২০ জনের ওপর ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের শিল্পী দিনরাত পরিশ্রম করছেন। ইডেনের দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলছেন এক খেলোয়াড়ের ময়দান থেকে ভারতীয় দলে যাত্রার রূপকথার কাহিনী।
এক বিশাল গোলাপি বেলুন ছাড়া হয়েছে ইডেন থেকে। সারা ভারত যা চাক্ষুষ ও টিভির পর্দায় দেখতে পাবেন। এক ডজন বিলবোর্ড, ছ'টা এলইডি বোর্ড, বাসে বাসে ব্র্যান্ডিং চলছে। সারা শহর জুড়ে থাকছে পিঙ্ক বল টেস্টের ব্যাপারে মানুষকে অবগত করার নানা সামগ্রী। হেরিটেজ বিল্ডিং সাজছে গোলাপি আলোর আভায়।
সিএবি আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলাদেশের প্রচুর গণ্যমান্য ব্যক্তিও থাকবেন এই ম্যাচে। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়কের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন তাবড় ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। এঁদের আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখতে চায় না সিএবি। আপ্রাণ খাটছেন কর্মীরা। কারণ আয়োজনে খামতি রাখা যাবে না এহেন যজ্ঞে।
নতুন দিশার জন্য সৌরভের দিকে তাকিয়ে সকলে
সবার নজর বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের প্রথম পদক্ষেপ পিঙ্ক বল টেস্টের দিকে। এই টেস্ট যদি সফল হয়, তাহলে টেস্ট ক্রিকেট উত্তরণের পথ পাবে সৌরভের হাত ধরে। টেস্ট ক্রিকেট, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তর। সৌরভ দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন দিবা-রাত্র টেস্টের পক্ষে। চেয়েছিলেন টেস্টে যাতে মাঠে দর্শক ফেরেন। টেস্ট ক্রিকেটের ভগ্নদশা অনেক দিনই লক্ষণীয় ছিল। একটা সংস্কার ও দৃৃঢ় পদক্ষেপ দরকার ছিল। যা নিলেন সৌরভ। ইডেন ভর্তি থাকলে দিশা পাবে আইসিসি ও বিসিসিআই।
শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলাম পড়ুন এখানে