আর ঘণ্টাকয়েক পরেই ম্য়াঞ্চেস্টারে মুখোমুখি ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আমাদের বিশ্বকাপ বিশেষজ্ঞ শরদিন্দু মুখোপাধ্যায় এই ম্যাচের প্রিভিউ করলেন। বেছে নিলেন উইন্ডিজ দলের কয়েকজন তারকা ক্রিকেটারকে, যাঁরা ম্যাচে ফারাক গড়ে দিতে পারেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের চরিত্র বিশ্লেষণও করলেন প্রাক্তন এই ভারতীয় ক্রিকেটার। ভুবনেশ্বর কুমার বনাম মহম্মদ শামির ইস্যুতেও বক্তব্য রাখলেন তিনি। এমনকী ধোনির সমালোচকদেরও মুখ বন্ধ করে দিলেন।
কেমন খেলবে উইন্ডিজ?
পাকিস্তানের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজও ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল একটা টিম। যে কোনওদিন অত্যন্ত ভাল দলকে ধুলিসাৎ করে দিতে পারে, আবার অত্যন্ত সাধারণ দলের বিরুদ্ধেও সাদামাটা পারফর্ম করে হেরে যেতে পারে। ম্যাচের আগে ওদের মূল্যায়ন করা সম্ভবই নয়। নির্দিষ্ট দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেমন খেলবে, একমাত্র ওরাই জানে। যেমন এই বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল হিসেবে এখনও সংঘবদ্ধ হতে পারেনি, টিম হিসেবে খেলতেই পারেনি। তবু ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে কয়েকজন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারের কথা আলাদা করে বলতেই হবে।
ক্রিস গেইল: এখন ক্রিকেট জীবনের সায়াহ্ণে। কিন্তু মাঝেমাঝেই ব্য়াট হাতে যৌবনের ঝলক দেখিয়ে যাচ্ছেন। আগের ম্যাচেই ৮৪ বলে ৮৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এখনও কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক নম্বর ব্য়াটসম্য়ান। এ বিষয়ে কারোর কোনও দ্বিধা থাকতে পারে না। গেইলকে ইনিংসের শুরুতেই ফেরাতে হবে। ১০ ওভারের মধ্যে তাঁকে আউট করাটা অত্যন্ত জরুরি। আমি অবাক হব না, ভারত যদি গেইলের বিরুদ্ধে একদিক থেকে জসপ্রীত বুমরা এবং অন্যদিক থেকে স্পিনার দিয়ে শুরু করে। আমি বলব যুজবেন্দ্র চাহালের পরিবর্তে বুমরার সঙ্গে কুলদীপ যাদব শুরু করুন। গেইল ক্রিজ থেকে বেরিয়ে যান, কুলদীপের গুগলি ভিতরে ঢুকে আসে। চাহালকে উইথ দ্য স্পিন খেলতে সুবিধা হবে গেইলের। ওর সাধারণ লেগস্পিন। এভাবে পেসটা কেড়ে নেওয়া যাবে। আর বুমরার বোলিং খুব প্রথাগত নয়, কাজেই গেইল অস্বস্তিতে থাকতে পারেন।
শে হোপ: ওদের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভবিষ্য়তের ক্যাপ্টেনও বটে। পরিস্থিতি বুঝে ব্য়াটিং করতে পারেন। চেষ্টা করেন পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করার। আসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ওঁর ভূমিকাই একটা দিক ধরে রাখার। বাকিরা ওঁর সঙ্গে রোটেট করে ব্যাট করবেন। শিমরন হেটমায়ার, নিকোলাস পুরান এবং এভিন লুইস, প্রত্যেকেই স্ট্রোক প্লেয়ার। যদি শে হোপ ৪৪ ওভার টিকে যান, আর বাকি স্ট্রোক প্লেয়াররা নিজেদের কাজটা করে দেন, তাহলে কিন্তু ম্যাচে ভারত চাপে পড়ে যাবে। গেইল এবং হোপকে দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠানো অত্যন্ত জরুরি। বাকি যাঁরা স্ট্রোক প্লেয়ার রয়েছেন, তাঁরা কিন্তু দু'টো ছয় মেরেও আউট হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু হোপ মানে নিশ্চয়তা।
কার্লোস ব্রাথওয়েট: এঁর কথা আলাদা করে বলব। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে যে চারজন পেস বোলার রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে পঞ্চম ফাস্ট বোলার হিসেবে যোগ হয়েছেন ইনি। ব্রাথওয়েট আমার কাছে বোলিং অলরাউন্ডারের থেকেও অনেক বেশি ব্য়াটিঁং অলরাউন্ডার। ব্য়াটিং অর্ডারে অনেকটা তলায় তাঁকে ব্য়াট করতে পাঠানো হয়। হয়তো এর আগের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত শতরানের পরেও ব্যাটিং অর্ডার একই থাকবে। কোনও পরিবর্তন হলেই অবাক হব।
ড্রে রাস: না থেকেও আন্দ্রে রাসেল একটা ফ্যাক্টর হতে চলেছেন এই ম্যাচে। ওঁর টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়াটা টিমের কাছে বিরাট ধাক্কা। এরকম একজন প্লেয়ার, যিনি ব্য়াট-বল হাতে যখন তখন খেলার হিসেব বদলে দিতে পারেন। একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, ওশেন টমাস, শ্যানন গ্যাব্রিয়েল ও শেলডন কটরেলের মতো ক্যারিবিয়ান পেসাররা নব্বই বা তার আশেপাশে বল করেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে দিশাহীন বোলিং করে ফেলেন। একজন পেসারের কাছে তাঁর গতিটা যেমনই অস্ত্র, তেমনই দিশাহীন গতি কিন্তু তাঁর শত্রু হয়ে যায়। এর ফলে প্রচুর রান হজম করে ফেলছেন ক্যারিবিয়ান পেসাররা।
গ্যাব্রিয়েল বলুন বা টসাস কিম্বা কটরেল, প্রত্যেকের বলই ভিতরে আসে, কিন্তু একজনও আউটসুইং করতে পারেন না। এঁদের সমস্যা হচ্ছে, হোল্ডার ছাড়া আর কারোর হাতে সুন্দর আউটসুইং নেই। পায়ের কাছে বা প্যাডের দিকে আসা বল ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের খেলতে সুবিধা হয়। এখন কিন্তু ৯০ বা তার বেশি গতিতে আসা বল খেলতে ভারতীয় ব্যাটসম্য়ানদের কোনও সমস্যাই হয় না। ভারত যদি ৩০০-র বেশি রান করে দেয়, তাহলে ক্যারিবিয়ানরা বিশাল চাপের মুখে পড়ে যাবে।
ভুবি বনাম শামি
ক্রিকেটের অনেক বড় ব্য়াক্তিত্বই মনে করছেন যে, আজ ফিট থাকলে ভুবিরই খেলা উচিত। শামির হ্য়াটট্রিকের পরেও একথাই ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু আমি বলব, গত ম্য়াচের হ্য়াটট্রিক করা বোলারেরই খেলা উচিত। ভুবি যদি আরও একটা ম্যাচ বিশ্রাম নেন তাহলে আরও ফিট হয়ে পরের ম্য়াচে নামতে পারবেন। তবে টিম ইন্ডিয়ার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক শেষ সিদ্ধান্ত নেবে, আবহাওয়া, পিচ আর প্রতিপক্ষ বুঝে কাকে খেলানো উচিত।
ধোনি ফ্যাক্টর
মহেন্দ্র সিং ধোনির মন্থর ব্যাটিং নিয়ে কিছু বলতে চাই। আমিও আগেও বলেছি, আবারও বলছি, ধোনি আর আগের মতো নেমেই মারতে পারেন না। ক্রিজে সেট হতে সময় নেন। ধোনিকে সময় দেওয়ার জন্য চার নম্বরে কেদার যাদবকে খেলিয়ে পাঁচে ধোনিকে নামানো হোক। বিজয় শঙ্করের জায়গায় পন্থ আর তারপর হার্দিক পাণ্ডিয়াকে নামানো হোক। এমনিতেই তিনজন পেস বোলার হয়ে গেল, আর দুজন স্পিনার তো রয়েছেনই। পাণ্ডিয়া আর পন্থের একটা ক্ষমতা রয়েছে। ওঁরা প্রথম বল থেকেই ছয় মারতে পারেন। ধোনির ওপর এমনিই চাপটা কমে যাবে।
আমার আরও একটা প্রশ্ন রয়েছে। বিজয় শঙ্করকে টিমে অলরাউন্ডার হিসেবে নেওয়া হয়েছে, কিন্ত গত ম্যাচে বল করানো হয় নি। ক্যাপ্টেনেরই ওর ওপর বোলার হিসেবে আস্থা নেই। তাহলে শুধু চারে ব্য়াটিং করানোর জন্য় শঙ্করকে নেওয়ার কোনও মানে হয় না। চারে খেলুন কেদার। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় খেলতে পারেন। আর যাদব পরের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবেন না। এই ভারতীয় দলটাও বদলে যাবে।
গত ম্যাচে ধোনির মন্থর ব্যাটিংয়ের পিছনে একটাই কারণ রয়েছে। ধোনি বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি আউট হয়ে গেলে দলটাই অল আউট হয়ে যাবে। ধোনির রানটা বাদ দিলে কিন্তু ভারত ম্যাচটা হেরে যেত। আরে ওঁর ২৮ রানের সঙ্গে পার্টনারশিপটাও হয়েছে তো! এটাও মাথায় রাখতে হবে, আফগানিস্তানের তিনজন বিশ্বমানের স্পিনার রয়েছেন। তাঁদের খেলাটা এত সহজ নয়। ধোনির সাপোর্টের জন্য়ই ছয়ে পন্থ খেলুন। উনি যথেষ্ট বেপরোয়া ক্রিকেট খেলতে পারেন। ১০ বলে ৩০ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। প্রতি বিশ্বকাপেই এক্স-ফ্যাক্টর থাকে। ২০১১-য় এক্স ফ্যাক্টর ছিলেন যুবরাজ সিং। পন্থকে যখন নেওয়া হয়েছে, তাহলে অবশ্যই খেলানো উচিত।